'এইভাবে আসলে হয় না! ফার্স্ট সিজনেই ট্রফি না জিতলেই কি কোচরে স্যাক করা যায়?'
'টিমটা কিন্তু দারুণ খেলতেছিলো, কোচ চেঞ্জ করানোর কোনো দরকারই ছিলো না।'
'চেঞ্জ করে কারে আনলো, সেটাও একবার দ্যাখ! এর তো আগে বড় টিম চালানোর কোনো এক্সপেরিয়েন্সই নাই!'
'আরে নগদ টাকা আছে তো হাতে, যা খুশি তা-ই করতেছে। আজকাল তো টাকা থাকলেই সব হয়, ক্লাবের লিগ্যাসি-টিগ্যাসি লাগে না।'
কোনো ক্লাব দলের ফুটবল ঐতিহ্য নিয়ে মতামত দেয়া আরিফের জন্য অসম্ভব। পেপার আর ফেসবুকে ছবি দেখে মেসি-রোনালদো-নেইমারের বেশি কিছু সে জানে না, তো বলবে কী? অজ্ঞানতার জন্য আরিফ তাই মুখ খোলা দূরে থাক, কোনো প্রতিক্রিয়া দেখানোর সাহস পর্যন্ত পায় না। সে বরং তাকিয়ে থাকে ঘরের অন্য প্রান্তের টেলিভিশনটার দিকে। কামিজের ওপর থেকে দাঁড়িপাল্লার মতো করে লম্বা ওড়না ঝুলিয়ে খবর পাঠরত মেয়েটাকে দেখতে মুনার মতোই লাগে। মেয়েটার সাথে অনেকদিন দেখা হয়নি। সেই যে সপ্তা দুয়েক আগে লাস্ট দেখা, তারপর থেকে মুনার আর কোনো খবর নাই।
মুনা আম্মার ছোটবেলার বান্ধবী মুক্তা আন্টির মেয়ে, ওরা থাকে আরিফদের গলির উল্টাদিকের সেলুনটার দুই বাড়ি পরের বাসাটায়। আরিফের বছর দুয়েকের ছোট এবং গায়ের রঙ শ্যামলা হলেও মুনার খুব পার্ট, সুযোগ পেলেই বাঁকা বাঁকা কথা শোনায়। হিন্দি ও কলকাতার বাংলা সিনেমা সাপ্লাই নিতে মেয়েটা প্রায়ই আরিফের বাসায় আসে, শেষবার এসেছে দুই সপ্তাহ আগে। আরিফের ঘর তখন ভালোই অপরিষ্কার, এর মাঝেই সে যখন ল্যাপটপ খুলে সিনেমা নির্বাচন করতে গিয়ে খুঁতখুঁতে হয়ে উঠছে, মুনা তখন হাসতে হাসতে শুনিয়ে দিলো, 'কম্পিউটারটা দেখি আপনার রুমের মতো এলোমেলো হয়ে আছে আরিফ ভাই!'
হাসিহাসি মুখ করে থাকা আরিফের তখন ভেতরে খুব রাগ হয়। কিন্তু কী উত্তর দেবে, তা গুছিয়ে আনবার আগেই মেয়েটা চলে যাওয়ায় জবাবটা আর দেয়া হয়নি। মেয়েটা বোধহয় এই মুলতবি হয়ে থাকা খোঁচার ভয়েই চুপ মেরে গেছে! নাহ, ভুল আসলে আরিফের, তারই উচিৎ ছিলো মুনাকে ফোনে কি ফেসবুকে নির্ভয়বাণী প্রদান। আরিফের ওপর যে সে নিরঙ্কুশ আস্থা স্থাপন করতে পারে, এ ব্যাপারটা মেয়েটাকে পরিষ্কার করে বোঝানো দরকার। আজই আরিফ মুনাকে ফেসবুকে নক করবে। কিন্তু আগ বাড়িয়ে খবর নিলে মেয়েটা আবার তাকে ছ্যাবলা ভেবে বসবে না তো? উভয় সংকটে বিব্রত আরিফ রয়েল রেস্তোঁরার লালচে ও প্রায় অপ্রতুল আলোতে সারা ঘরে দৃষ্টি ফ্যালে।
ঘরের অল্প কিছু টেবিলের মানুষ এখনও খাওয়ায় ব্যস্ত। খাবারের ধ্বংসাবশেষের সামনে রেখে বিল দিতে প্রস্তুত কাস্টোমারের সামনে বকশিসের লোভে নতজানু বয়-বেয়ারা কয়েকটি টেবিলের শোভা বাড়ায়। টাকাপয়সার হাতবদল দেখতে গিয়ে ঘড়ির কাঁটা সাড়ে দশ পেরিয়ে নীরবে বসে থাকে। ঘরের দুই প্রান্তে দেয়ালে ঝোলানো টিভি দুটোর একটিতে চলে রাতের সংবাদ, অন্যটিতে চলে ইউরোপের ক্লাব ফুটবলের লড়াই। এই খেলা দেখেই সবাই ফুটবলের আলাপ শুরু করলো। আরিফ এসব ভাবতে ভাবতেই কারো জন্য চা, কারো জন্য রয়েলের বিখ্যাত লাবাং চলে আসে। আর আলোচনা এদিকে ফুটবল থেকে সরে গিয়ে পড়ে ক্রিকেটে ।
'ওইদিন শালা কী ম্যাচটা হারলাম! নাসিম যুদি ক্যাচটা মিস না করতো...' বাংলাদেশ হারার শোকে লাবাং-এর গ্লাসে চুমুক দেয়া কৃষ্ণ নিজের কথা শেষ করতে পারে না।
'আইপিএলের জন্যে করে এগুলা বুঝোস না? ইন্ডিয়ার ক্যাচ নিলে অগোরে আর আইপিএলে ডাকবো?' ভারতের ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগের প্রতি সেলিমও অনেক রাগ।
তানভীর চোখ টিপ দেয়। 'ঠিকই করছে, আইপিএলে না গেলে কি কারিনা আর আনুশকারে দেখা যায়?'
এ যুক্তিতে আড্ডার অনেকেই একমত। হ্যাঁ, কারিনা কী আনুশকার জন্য হলেও আইপিএলটা দেখা দরকার। আরিফের অবশ্য এসব নায়িকা ছাড়াই ক্রিকেটে আগ্রহ আছে। আইপিএল তার একেবারে অপরিচিত নয়। মানে ওই প্রথম যখন টি-টোয়েন্টির ক্রেজ চালু হলো, তখন নিয়মিত দেখেছে আর কী। এখনো মাঝে মধ্যে টিভির সামনে বসলে দুয়েকটা খেলা দেখে ফেলা হয়, বিশেষত বাংলাদেশের কেউ খেলায় থাকলে। তবে ওসব নিয়ে এখন কথা বলা মুশকিল, আইপিএল দেখে বললে হয়তো তাকে ইন্ডিয়ার দালালই বানিয়ে দেয়া হবে এক কথায়। এই হ্যারাসমেন্টগুলো অ্যাতো ডেঞ্জারাস! মুখের লাগাম নেই কারো, যে কাউকে যে কোন কিছু ডেকে ফেলা যায়। আরিফ আর ওদের মতো হতে পারলো কই? দরকারী কথা বলতে গিয়েই অনেক সময় সে সংকোচে চুপ করে থাকে। এখনও যেমন হিমেলকে সে বিলবোর্ডের ঝোলানো মেয়েটার নামই জিজ্ঞেস করতে পারলো না। সংকোচে আরো গুটিয়ে যাওয়া আরিফ চোখ বুজে চায়ের স্বাদ নেয়। তার মাঝে টিভির নিউজ প্রেজেন্টারের দিকে যতবার চোখ যায়, মনে পড়ে মুনার কথা।
তবে ফেরার পথে হিমেলের সাথে রিকশায় ওঠার খানিক পরেই লালবাগের চিপা গলির গ্যাঞ্জামে মুনা একেবারে নিখোঁজ হয়ে যায়। মাথার ভেতরে এই নিখোঁজ সংবাদ নিয়ে কোনো মডেলের ফেসবুক পেইজ সংক্রান্ত অনুসন্ধান করতে আরিফের আটকায়, সে বরং বলে,'একটা টিউশনি দে না দোস্তো! আমার হাত এখন একদম খালি।'
পুরান ঢাকার এদিকটা বেশ ঘিঞ্জি। চিপা গলির কারণে এই রাত প্রায় এগারোটাতেও রিকশা-গাড়ি সবই এক সারিতে আস্তে ধীরে এগোয়। কোথাও লম্বা কোনো দালানের নির্মাণ কাজ চলে, তার সারা গায়ে জালের আস্তরণ। রাতের বাতাসকে ছিঁড়ে দিয়ে মাইকে ভেসে আসে কোনো হুজুরের সুরসমৃদ্ধ উচ্চারণ। শুধু শুধু মাইকের জোর বাড়িয়ে মানুষকে কষ্ট দেওয়া! সবাই বিরক্ত হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু কিচ্ছু বলা যাবে না। খাবার দোকানগুলোর সামনে এখনো কিছু ভিড়, সে সব জমায়েতে অত্র এলাকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর আবাসিক ছাত্রদের প্রাধান্যই বেশি। রিকশা ঢাকেশ্বরী মন্দির পর্যন্ত চলে এলে খাদ্যরসিক তরুণসমাজ মিলিয়ে গিয়ে কেবল থাকে প্রবল বাতাস, শীতের কাপড় কি এবার তাহলে বের করতেই হবে?
হিমেল প্রথমবারে আরিফের কথার উত্তর দেয় না। দ্বিতীয়বার অনুরোধ করলে বলে, 'টিউশনি তো নাই। তবে পার্ট টাইম জব আছে একটা, করবি?'
'কীসের পার্ট টাইম, জব?'
'ওই আমাদের রিসার্চ ফার্মে। চইলে আয়, টিউশনির মতোই দিবে।'
না চাইলেও আরিফের মাথার ভেতর একজোড়া ছবি ভাসে। একটায় এনার্জি বাল্বের আলোয় তেলাপোকা রঙ টেবিলে কোনো ছাত্রকে সে অংক করায়, অন্যটায় কর্পোরেট কোনো অফিসের কনফারেন্স রুমে স্যুট পড়া এক মোটাসোটা ভদ্রলোকের বিপরীতে বসে ঘামে। তবে ছাত্র বা মোটকা ভদ্রলোক, কারো মুখই ঠিক স্পষ্ট নয়। কাউকেই ঠিক পছন্দ হয় না বলে দুটো ছবিই আরিফ দ্রুত ভেঙে ফেলে। 'তোরা একচুয়ালি করিসটা কী বলতো!'
ইডেন কলেজের উল্টো দিকের ফুটপাথ এখন খালি, ঘন্টাদুয়েক আগেও এলাকাটার ফুচকা আর চায়ের দোকানগুলো ছিলো কানায় কানায় ভরপুর। ঝাঁপ ফেলা ওসব ভাসমান দোকানের দিকে তাকিয়ে হিমেল একটু আনমনা। 'এই তোর মনে কর - রিপোর্ট লেখা, সেগুলা অনুবাদ করা। ডাটা এনালিসিস। ইন্টারেস্টেড পার্টির জন্য প্রেসেন্টেশন বানানো।'
'কী নিয়ে রিপোর্ট?'
'হিউম্যান রাইটস ভায়োলেশন, এথনিক অপ্রেশন- কতরকম ইস্যু!'
'ওই যে আদিবাসী অধিকার আন্দোলন টাইপের যেসব নিউজ মাঝে মধ্যে পেপারে দেখি?' আরিফ ব্যাপারটি নিশ্চিত করতে চায়।
বামপাশে আজিমপুর কলোনির দেয়ালের ওপারে একটার পর একটা সাদা দালান গট গট করে হেঁটে সরে যায় কালো আকাশের পট থেকে, হিমেলের চোখ এখন ওদিকে। প্রায় ফাঁকা রাস্তায় বাস, মালবাহী ট্রাক আর রিকশা সব হাতে গোণা যায়। হোম ইকোনমিক্স কলেজ পেরিয়ে চৌরাস্তার সিগনালে পৌঁছে গেলে চোখে পড়ে নিউমার্কেট কী নীলক্ষেতের দোকানগুলোর সাথে সংশ্লিষ্ট নিম্নবিত্তদের কয়েকটি অপুষ্ট নমুনা। চোখের মাঝে এদের ঢুকিয়ে নিতে ব্যস্ত হিমেল সঙ্গীর দিকে মনোযোগ দেয় রিকশা নীলক্ষেত থানার সামনে আসার পর। 'তুই কি আসলেই কাজ করতে চাস?... টাকাপয়সা বেশি না দিলেও চাকরি কিন্তু হুট কইরে যায় না। আমাদের রানিং প্রোজেক্টটাই তো মনে কর আরো দেড় বছর পর শেষ হবে। চন্দন ভাই হুট করে চাকরি ছেড়ে দিসে দেখে এখন লোক লাগতেছে। কাজ আছে,কিন্তু করতে তোর খারাপ লাগবে না।'
'টাকা পয়সা কিছু পাইলে তো ভালোই হয়।' আরিফ সতর্ক স্বরে মন্তব্য করে।
চাকরিতে ঢোকা নিয়ে আরিফ এখনো কিছু ভাবেনি, কিন্তু অর্থ-সমাগম নিয়ে তার কোনো আপত্তি নাই। আর একটা ল্যাপটপ কেনা আসলেই খুব দরকার, আগেরটার চার্জ ইদানিং খুব দ্রুত চলে যায়। সেদিন জনির সাথে বসে নেট থেকে দেখে আরিফ বেশ কয়েকটা মডেল পছন্দ করলো। টার্মের শেষে পরীক্ষার জন্য বইপত্র কেনার অজুহাত দেখিয়ে বাসা থেকে হাজার কয়েক টাকা মারা যাবে, কিন্তু তাতে পছন্দের কিছু কেনা যায় না। আরিফ হিসাব করে দেখেছে, আরো প্রায় হাজার তিরিশ লাগে। সে ঠিক করে রেখেছিলো যে মাস ছয়েক টিউশনি করাবে। তবে ওর ছাত্র ভাগ্যটা খুব খারাপ। অংকুরের মতো ধইঞ্চ্যা পোলাপানও টিউশনি করতে গেলে স্টুডেন্ট হিসেবে হলিক্রসের মেয়েদের পেয়ে যায়, আর আরিফ এদিকে তিন বারের চেষ্টায় এখনো পর্যন্ত কোনো মেয়েকে পড়ানোর সুযোগই পায়নি! আবার আরিফের ভাগে পড়া ছাত্রগুলাও গাধার অধম। তার সেরা ছাত্র হেদায়েত রাব্বি, মণিপুর স্কুলের ক্লাস সেভেনের রোল বারো। ছেলেটা অঙ্কে ভালো, কিন্তু ওর ফ্যামিলিটা ছোটলোক। চার মাসের টিউশনি জীবনে রাব্বির মা এক কাপ চা পর্যন্ত আরিফকে অফার করে নাই কোনো দিন, ভাবা যায়?
'তাইলে চলে আয়। তোপখানা রোডের মাথায় অফিস। একদিন ব্রেকের সময়েই আমার সাথে চল না।' বন্ধুকে উদার আহবান জানিয়ে হিমেল পকেট থেকে মোবাইল বের করে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।
কাঁটাবন রোডের বাম পাশের যত দালান আর ডানপাশের যত গৃহপালিত মাছ-পাখি-কুকুরের দোকান, তারা এখন নিজেরাই পোষ মেনে ঝিমায়। মাঝে মাঝে দুয়েকটা রিকশা কি ট্রাক ছুটে পালালো, এছাড়া ধবধবে আলো লুটানো রাস্তায় মানুষ নাই। ফুটপাথে দাঁড়িয়ে ধোয়ামোছার কাজ সারে একটা চা-ওয়ালা, তার দক্ষ হাতের নড়াচড়া দেখতে দেখতে আরিফ হাই তোলে। মোরগ পোলাওটা ভালোই ছিলো, সন্ধ্যাটাও মন্দ লাগেনি। রয়েলের এসব হঠাৎ মোরগ পোলাও অভিযান, শীতের সন্ধ্যায় চায়ের গরম, এসব বন্ধুত্বের মুহুর্ত আর বেশি দিন পাওয়া যাবে না- ভেবে বেশ একটু মিহি ভাবালুতায় আক্রান্ত হওয়া যায়। সামনের পরীক্ষাটা হয়ে গেলেই তো সব শেষ। তারপর বাবা সবার রাস্তাই আলাদা। আর পোলাপানও আজকাল হেব্বি ক্যারিয়ারিস্ট হয়ে গেছে। সোহেল আর মঞ্জুর মতো ক্ষ্যাতগুলা যখন ফার্স্ট ইয়ার থেকেই লাইব্রেরিতে বিসিএসের জন্যে পড়াশোনা করতো, তখন আরিফরা তাদের নিয়ে মশকরা করতে ছাড়েনি। অথচ এই ফাইনাল ইয়ারে এসে এমনকি সেলিম পর্যন্ত আজকাল কারেন্ট অ্যাফেয়ার্সের বিশেষ সংখ্যা নিয়ে কুত্তার মতো প্রিপারেশনে ব্যস্ত। এখানেই শেষ না, শালা আবার ফেসবুকেও দিনরাত সিভিল সার্ভিস কোচিং-এর জনপ্রিয় শিক্ষক সুমন নাগের নোটপাতি সমানে শেয়ার করে, আন-বিলিভেবল!
সত্যি বলতে, প্রকাশ্যে স্বীকার না করলেও আরিফ নিজে দুয়েকবার ওসব চেষ্টা করে দেখেছে। কিন্তু মোজাম্বিকের রাজধানী আর অ্যাপেকের সদস্য সংখ্যা দিনের পর দিন মুখস্থ রাখা যেমন টাফ, ইংলিশের প্রিপোজিশন আর সংবিধানের ধারা মনে রাখা তেমনই অসম্ভব। সপ্তাহ তিনেক চেষ্টা করেই আরিফ তাই হাল ছেড়ে দিয়েছে। আরে চাকরি-টাকরি কিছু একটা না হলে সে কি একেবারে ভেসে যাবে? বাপের চারতলা বাড়ির একটা অংশ তো তার পাওয়া উচিত। ঢাকা ভার্সিটির পাবলিক অ্যাডে পড়া ছাত্র সে, দরকার পড়লে কি দুয়েকটা টিউশনিও কি যোগাড় করতে পারবে না? অ্যামনও তো হতে পারে, টিউশনিতে তার নেক্সট স্টুডেন্টটাই ভিকারুন্নিসা বা হলিক্রস বা সিটি কলেজের কোনো চোখ ধাঁধাঁনো সুন্দরী হবে! সুন্দরী সেই ছাত্রী তার সাথে প্রেম করতে চাইলে ব্যাপারটা কী দাঁড়াবে? আরিফ ভাবনায় পড়ে। চেহারা তো তার খুব একটা খারাপ না। আয়নায় দাঁড়ালে দেখা যাবে লম্বা নাক, চুলে অর্ধেক ঢেকে থাকা কপালের নিচের গালে সাদা দেয়ালে পানের দাগের মতো গাঢ় একটা ছোট্ট ছোপ, রঙটাও ফর্সার দিকেই। কথাবার্তাও তার চলনসই। এরকম বহু গুণের আধার ছেলেকে অপছন্দ করার কোনো ছুতা না পেয়ে সম্ভাব্য সুন্দরী ছাত্রীটি আরিফকে পছন্দ করে ফেললে করার কী আছে! মেয়েটা কি তাকে টিউশনি থেকে বেরিয়ে আসার পরে টেক্সট ম্যাসেজ দেবে? অথবা রাত এগারোটার পরে অঙ্ক বুঝতে চাওয়ার অজুহাতে মোবাইল কল? পরিচয় একটু গাঢ় হলে আজকের মতো কোনো রাতে কি তারা রিকশায় চড়ে ঘুরে বেড়াবে?
হাতিরপুল কাঁচাবাজারের কাছে এসে নাম না জানা মেয়েটাকে রিকশায় জায়গা দেবার জন্যে আরিফ একটু নড়ে বসতেই পাশে বসা হিমেল বিরক্ত হয়। 'কী রে, ঠেলে ফেলে দিবি নাকি?'
'রাস্তার যে-ই অবস্থা!' লজ্জা পেয়ে আরিফ অপ্রস্তুত ও ইতস্তত নিচু স্বরে অজুহাত দেয়।
রাস্তার ঝাঁকুনির দিকে ইঙ্গিত পেয়ে হিমেল আর কিছু বলে না। মোবাইলের স্ক্রিনে ক্রমাগত নড়াচড়া করতে থাকা বুড়ো আঙুল দুটোকে বিশ্রাম দিয়ে সে এবার ফোনটাকে পকেটে রাখে। তবে রাস্তার দুরবস্থা সে নীরবে সহ্য করে না। কখনো রাস্তা মেরামতের ঠিকাদার, কখনো মেয়র, কখনো ভারি গাড়ির চালক- সবাইকেই হিমেল বকাঝকা করে। ছেলেটা নামবে এই রাস্তার মাথায়, কাজেই পথ ফুরিয়ে যাবার আগেই ক্ষোভপ্রকাশ সম্পন্ন করবার জন্য সে খুব উতলা হয়ে ওঠে। রিকশা যতই এগোয়, তার গালিগালাজের গতিও তত বাড়ে। শেষ পর্যন্ত বাংলামোটর লিঙ্ক রোডের মাথায় মসজিদটার সামনে আসার পরই হিমেল থামে, 'ওকে দোস্ত, তুই যা গা! দেখা হবে পরে। আর আমি যা বললাম, ওইটা খেয়াল রাখিস।'
হাত নাড়িয়ে বিদায় জানানোর পরেও আরিফ খানিক তাকিয়ে থাকে, কিন্তু হিমেল ওর দিকে একদম না চেয়ে ঢুকে যায় কাঁঠালবাগানের পেটে। এই গলিতে ঢুকে বিশ গজ গেলেই হাতের ডানে হিমেলের বাসা। অ্যাপার্টমেন্টটা আরিফের চেনা। বন্ধুরা মিলে ওই বাসার ছাদে ওরা বেশ কয়েকদিন আড্ডা মেরেছে, আলাপ জমানোর জন্য জায়গাটা চমৎকার।
হিমেল একেবারে টিপিকাল হায়ার মিডল ক্লাস যেটাকে বলে আর কী। আঙ্কেল বারডেমের ডাক্তার, বিকালের পরে গ্রিন রোডের ওদিকে কোথাও বসে আর দুই হাতে টাকা কামায়। সেই ইনকামে ছেলে তার খুব ইন্টেলেকচুয়াল বই-টই পড়ে, ভারি ভারি সিনেমা দ্যাখে। তবে ছেলেটা কিন্তু আসলেই ভালো, দেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন প্রসঙ্গে তার আবেগটা খাঁটি। লন্ডনের পাতালরেলে সন্ত্রাসী হামলা থেকে শুরু করে রোহিঙ্গাদের ওপর সামরিক আগ্রাসন, সব বিষয়ে হিমেলের সমান দখল। নোংরা রাজনীতি করে না ঠিকই, তবে সে প্রসঙ্গেও হিমেল শক্ত সব মতামত নিয়মিত দিয়ে থাকে। সাথে এনজিও'র হয়ে রিসার্চের কাজকর্মেও ছেলেটা উদ্যমী। ওর সাথে পার্ট-টাইম কাজ করার প্রস্তাবটা তাই ফেলে দেয়া যায় না।
আরোহী কমিয়ে চাঙা হয়ে ওঠা রিকশাটা মগবাজারের দিকে এগোতে থাকলে চিন্তা বাদ দিয়ে আরিফ পুনরায় সতর্ক হয়ে ওঠে। রাত এগারোটার সুযোগ নিয়ে সামনের চৌরাস্তায় সিগন্যাল মানার কোনো বালাই এখন নাই, ফলে রিকশাওয়ালা একটু অসতর্ক হলেই সোজা কোনো ট্রাকের তলায় চলে যেতে হবে। আবার এমন ফাঁকা রাস্তাতেই ঢাকায় ছিনতাই হয় বেশি, সুতরাং চারপাশ নজর রাখা লাগে। এসব সময়ে সাবধান থাকাটা খুব দরকার।