আজ ক্লাস নেই।
অন্যান্য দিন দুপুরের এসময়টা মঞ্জু ক্লাসে থাকে। স্যারের কথা নীরব ক্লাসরুমের কোণায় কোণায় হানা দেয়, অল্প কজন নোট নেয়, তবে অধিকাংশই কষ্ট করে চোখজোড়া খোলা রেখে হাই তুলতে ব্যস্ত থাকে। দুপুরে যেন কারো কোনো তাড়া থাকে না, কলেজের চারপাশ একদম খাঁ খাঁ। কোথাও কুকুর ডাকলো, কী দূর থেকে কোনো মোটরগাড়ি আওয়াজ দিলো- ওসব শব্দও কানে আসে নির্বিঘ্নে। মঞ্জু তখন খাতায় ক্লাসনোট তুলতে তুলতে এলোমেলো হয়। হাজারো পরিকল্পনা নিয়ে সে পাহাড়ে পাহাড়ে ঘোরে, পাতার বাঁশি বাজায়।
তবে কয়েক সপ্তাহ ধরে দুপুরের ক্লাস আর নীরব নাই। কলেজটাকে নতুন করে সাজানো হচ্ছে বলে নানা রকম আওয়াজের ঠ্যালায় এখন শান্তিতে ক্লাস করাই মুশকিল। বড় বড় ট্রাকে ইট আসে, কন্টাকটরের লোকেরা সেগুলো নামাতে গিয়ে বিশ্রী রকম চিল্লায়, সিমেন্ট গুলানোর মেশিনটা অসুস্থ বয়স্ক মানুষের মতো কাশে একটু পরপর। নতুন ল্যাবরেটরির কাজ কয়েকদিন আগেই শেষ হয়েছে। নয়া অফিস বিল্ডিংটাও রেডি, কিন্তু এখনো রঙ করা হয়নি। সামনে নাকি ফিজিক্স-কেমেস্ট্রির জন্যে আলাদা ফ্যাকাল্টি আর হোস্টেলও হবে। কবে হবে কে জানে, কাজকর্মের গতি খুব ধীর। বাঙালিদের ভুলিয়ে রাখতে পাকিস্তানি গভমেন্ট অনেক কিছুই করছে, সরকারের দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় মঞ্জুদের চিটাগং কলেজের জন্যে বিশেষ বাজেট বরাদ্দ করাও সেই প্রচেষ্টারই অংশ। কিন্তু এসব করে কি পাকিস্তানিরা নিজেদের শোষণ ঢেকে রাখতে পারবে? নাহ, বঞ্ছনা কখনো ঢেকে রাখা যায় না।
চন্দ্রঘোনা মিলের কথাই ধরো। পাকিস্তান গভমেন্টের অ্যাতো বড় গর্ব ওই মিল, কিন্তু সেখানে জুম্মদের মধ্যে থেকে শ্রমিক আর স্টাফ হতে পেরেছে কজন? মাঝখান দিয়ে কাপ্তাই এলাকার গাছ সব কাটা হয়ে যাচ্ছে।
মঞ্জুর মাথায় চিন্তার বিরাম নেই। পাহাড়ের পর পাহাড় গাছ কেটে উজাড় হবার দৃশ্যে ঘুরতে ঘুরতে চন্দ্রঘোনা মিল হয়ে যায় চিটাগং কলেজ। এই যে এতো কিছু হচ্ছে উন্নয়নের নামে, মানুষের কাছে এটার ফলাফল কীভাবে যাবে? এদিকের পাট বেচার টাকা নিয়ে ওদিকে মরুভূমিতে নদী বানানো হচ্ছে। বড় বড় পদে সবাই পশ্চিম পাকিস্তানি। এদের কারণে পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিরাই যেখানে সুযোগ পাচ্ছে না, সেখানে মঞ্জুরা তো গোণার বাইরে। অবশ্য গত বছর প্রথমবারের মতো শরদিন্দু শেখর চাকমা নামে একজন সিভিল সার্ভিসে ঢুকেছেন। এসব বিক্ষিপ্ত ঘটনায় একটা শুরু হয়তো দেখা যাচ্ছে, কিন্তু শেষে যে কী হবে, সেটা ঠিক স্পষ্ট নয়।
পড়ার টেবিল থেকে উঠে মঞ্জু জানালায় যায়। মাথার ভেতরের সমস্ত বেলুন উড়িয়ে নিয়ে যায় বাতাস, ঝাপটা মেরে চোখে ঢুকে পড়ে সবুজ। পাথরঘাটার এদিকটা এখনো বেশ ঠাণ্ডা, বিকালে বা সন্ধ্যায় হাঁটতে ভালো লাগে। একটু জোরে বাতাস বইলে আশপাশের এলাকা থেকে বাঁদরগুলো হোস্টেলের সামনের ওই পিঠ-বাঁকা বটগাছে এসে মিটিং বসায়। কোনো সন্ধ্যায় ভাবতে ভাবতে মাথা গরম হয়ে গেলে মঞ্জু যখন হাঁটতে বেরোয়, ওই গাছের দিকে তাকিয়ে থেকে মাওরুম পারের বটগাছটা চোখে না আনা পর্যন্ত সে ঠাণ্ডা হয় না। মাওরুম পারের ঐ বটগাছ কি তার আত্মীয়ের চাইতে কম? মঞ্জুর বাপে খুলেছিলো 'ছোট মহাপুরম উচ্চ বিদ্যালয়', সেটা আবার মঞ্জুর সাথে সাথেই বেড়ে উঠে হয়ে গেলো 'মহাপুরম জুনিয়র হাইস্কুল'। সেই স্কুলের পশ্চিমে দিকে মহাপুরম গ্রামের মাঝ দিয়েই মাওরুম নদী। তা সেই নদীতীরের বটগাছে বাঁদরদের অনুপস্থিতিতে মঞ্জুই দিনরাত দোল খাবে, সেটাই তো স্বাভাবিক!
নদীর উপরে শিকলে বানানো ব্রিজ, মানুষ উঠলে সেটা ভয়ে কাঁপে। ভীতু এই সেতুটিকে দেখে মঞ্জু ছোটবেলায় খুব মজা পেতো। বাঁদরদের সভাস্থল সেই বটগাছের তলায় গিয়ে ঝুলতে থাকা সেতুটার দিকে চেয়ে মিনু দিদি যে তখন কতবার অকারণে হেসেছে! দিদিটা আসলে পাগল ছিলো। মন চাইলো, তো 'চিক্ক! চিক্ক! হুদু গেলে ভেইধন?' বলে বাড়ি মাথায় করে ফেলতো মঞ্জুকে খুঁজতে খুঁজতে, আবার কোনো কোনো দিন ভাইয়ের একদম খোঁজই করতো না।
এখন সেই গ্রাম নেই, কাপ্তাই বাঁধ গিলে নিয়েছে। কিন্তু তাতে কিছু এসে যায় না। জ্যোছনা রাতের ওসব ইমোশনাল মুহুর্ত বাদ দিলেও ঐ মহাপুরম থেকে মঞ্জুর কি আর মুক্তি মেলে? স্যারের গলায় কাঁপতে থাকা চিটাগং কলেজের নির্জন দুপুর, কিংবা শেষ বিকালে পাথরঘাটার এই হোস্টেলের ঝিরঝিরে বাতাস- মঞ্জুর মাথায় তো চব্বিশ ঘন্টার জন্য গ্যাঁট হয়ে বসেছে ওই গ্রাম, গ্রামের মাঝ দিয়ে চলে যাওয়া কাঁচা রাস্তা, সেই রাস্তায় এক যুগ আগে চালু করা নীহার বাবুর রাঙামাটি টু নানিয়ারচর বাস সার্ভিস। বাসের ঝাঁকুনিতে রাস্তা অসহ্য লাগলেও গতির যে আলাদা একরকম মজা, সেটাও তো তাদের তখনই প্রথম জানা হলো।
কিন্তু কাপ্তাইয়ে বাঁধ দিলে যে গ্রামের পর গ্রাম ওভাবে পানির তলায় ডুবে যাবে - সেটা তখনো ওদের জানা হয়নি। কানে এসেছিলো শুধু গুজব। সেসব শুনে সবার তখন দারুণ উৎকন্ঠা, কী হয়-কী হয়! তার মাঝেই মঞ্জুর কী খেয়াল চাপলো, এক টুকরা মাটি নিয়ে কাগজে মুড়িয়ে দিদির হাতে দিয়ে সাবধানে রাখার অনুরোধে সে বলে, 'দি, গমে থোচ! এ মাদিয়ানর ভালত্তমান দাম আগে সি।'
দিদি সেই মাটি হাতে নিয়ে অবাক হয়ে বলে, 'মঞ্জু, ইয়াননোই হি অব?'
মঞ্জু কথা না বলে হাসে। আর দিনকতক পরে বাঁধের পানি উঠে এলে সব কিছু ডুবে যায়।
দরজা ডুবে, গোয়াল ঘর ডুবে, বাতাসে একটু একটু সাঁতার কাটা ধানের শীষ ডুবে। কিন্তু যত্ন করে রাখা সেই মাটিটুকু ডোবে না। আর তারপর থেকে মাথার ভেতর দিন নেই-রাত নেই-ভাসা নেই-ডোবা নেই, ঘাঁটি গেঁড়ে বসে থাকা মহাপুরমের মাটি কেবল তাকে বলে যায়, 'কাজ করতে হবে রে মঞ্জু, কাজ করতে হবে!' কিন্তু মাথার মধ্যে জমিজমা সহ আস্ত একটা গ্রাম ওভাবে মশার মতো পিনপিন করে বলে কাজ করাটা মঞ্জুর জন্য মোটেই সহজ নয়।
হোস্টেলের এই যে সব নীরব দুপুরগুলো, অথবা পড়ার মতো বইটই না থাকলে রাতের খাবার আগে ও পরে, কিংবা ছুটির দিনে সকালে নাস্তার পরে আধঘণ্টা যাত্রা করে টাউনে যাবার ব্যস্ততা না থাকলে মঞ্জু যে একটু ভাবনা চিন্তা করবে, মাথার ভেতর বকবক করতে থাকা ওই নির্জীব বাড়িগুলোর জন্যে সেটা আর হয়ে ওঠে না। তার উপরে আছে টিকটিকি, যাদের লেজ নেই, সরকারী পোশাক কখনো গায়ে থাকে, কখনো থাকে না। গভমেন্ট বড় হুঁশিয়ার। এ বছর পাহাড়ি ছাত্র সম্মেলন আয়োজন করার সময় মঞ্জু বেশ অ্যাকটিভ ছিলো, শালারা সেই থেকে পিছু ছাড়ছে না। সব জুম্ম ছাত্রের উপরেই টিকটিকি লেলিয়ে দেওয়ার জন্য নাকি আইয়ূব খানের ডাইরেক্ট অর্ডার আছে। আর এই গোয়েন্দাগুলাও পারে বাবা, বুদ্ধিটাও যদি ঠিকমতো থাকতো! মঞ্জুর পেছনে যেটা ঘোরে, সেটা আবার সিনেমার নায়কদের মতো লম্বা জুলফি রেখেছে। এমন স্টুপিড, যখন তখন হোস্টেলে ঢুকে যায়, এর-ওর ঘরে গিয়ে কথা বলবার চেষ্টা করে। আবার ধরা খেলেও পিছ ছাড়ে না, মঞ্জুর সামনে পড়লে বোকার মতো একটা হাসি দিয়ে বেরিয়ে যায়। রাতের বেলা বাতাস খেতে নিচে নামলে রাস্তার ওপারে, দিনের বেলা ক্লাসে যাবার সময় বাস যাত্রায় সহযাত্রী হয়ে, কলেজের খেলার মাঠে বিকালে ঘাসের উপরে বসে একটু অবসরের মাখো মাখো ভাব আনলেই ওই শালা নিজের লম্বা জুলফি নিয়ে হাজির। কোনো মানে হয়!
কিন্তু ওসব মাথায় নিয়ে থেমে গেলে চলবে না। তোকে কাজ করতে হবে মঞ্জু, কাজ করতে হবে।
ডিগ্রীর সার্টিফিকেট দিয়ে কী লাভ যদি কোনো পরিবর্তন আনা না যায়? সরকারী চাকরি, না হয় বেসরকারী দাস- এই তো হতে হবে। কিন্তু জুম্ম জাতির ভাগ্য তাতে বদলাবে না। দরকার পথে নামা। সেই পথ এতো সহজ না যে বুড়িঘাট থেকে নাচতে নাচতে তাকে রাঙামাটি নিয়ে যাবে। মঞ্জুর প্রিয় বিষয় ইতিহাস। রাত জেগে ওই ইতিহাসের বই পড়তে গিয়ে সে টের পায়, তার চেয়ার ধরে দাঁড়িয়ে আছেন নেতাজী সুভাষ বোস আর মাস্টারদা সূর্যসেন। এদের আস্কারা পেয়ে মঞ্জুর সাহস দিনে দিনে বাড়ছে, কোনো গভমেন্টের সাধ্য নাই পেছনে টিকটিকি লাগিয়ে ওকে আটকায়। আর এসব তো আজকের কথা না, মঞ্জু তো অনেক দিন ধরেই প্রস্তুত হচ্ছে। কবে থেকে, তা মনে করার চেষ্টায় সে জানালা ছেড়ে গায়ের শার্টটা খুলে বিছানায় অর্ধেক শরীর চিৎ করে শুইয়ে দেয়।
বাবা বাড়ির নাম দিয়েছিলো অনোমা কুঠির, ঘর ছিলো সাতটা। এখনো মাঝে মাঝে দুপুরের ক্লাসে ঘুম লেগে এলে সেই ছনের ছাউনি মঞ্জুর নাকে গুটিগুটি মেরে ঢুকে যায়। ছনের গন্ধ একা আসে না, দল বেঁধে নিয়ে আসে বইয়ের ঘ্রাণও। কলকাতা থেকে বাবার নিয়ে আসা বই। মাসিক পত্রিকাও ছিলো অনেক- বসুমতি, শুকতারা। আর, মঞ্জুও পড়তো। পড়ার বই, গল্পের বই, পত্রিকা- বাদ দিতো না কিছু। পড়তে গিয়ে হুঁশ হারিয়ে ফেলার ঘটনা বহুদিন ঘটেছে। সন্তু কিন্তু অন্যরকম, সে ভারী দুরন্ত ছিলো। একবার যেমন ঘরের কোণে পাট রাখা গাদা গাদা করে, মঞ্জু একদিকে বসে বই পড়ছে। ওদিকে ঘরে বল ঢুকেছে, সেটা খুঁজতে গিয়ে সন্তু নিয়ে এলো চেরাগ। তো চেরাগ জ্বালিয়ে সন্তু আঁতিপাতি করে বল খুঁজছে, আর মঞ্জু এদিকে বই থেকে চোখই সরাচ্ছে না। পাছায় আগুনের ছ্যাঁকা লাগা পর্যন্ত মঞ্জু বুঝতে পারলো না যে ঘরে আগুন লেগেছে। ভাগ্যিস সেদিন মিনুদি ছিলো! তাদের দুজনকে সরিয়ে নিয়ে দিদিই চিৎকার করে লোক ডেকে আগুন নেভানোর ব্যবস্থা করলো। কিন্তু ওসব ঘটনায় মঞ্জুর বই পড়া কি আদৌ কমেছে? নাহ! বরং ওই যে পড়ার টেবিলে থরে থরে সাজানো বিএ ক্লাসের বইয়ের সাথে দেশি-বিদেশি সব বই দেখা যায়! স্কুল থেকেই মঞ্জু বৃত্তির টাকা দিয়ে বলতে গেলে শুধু বই কিনেছে।
তবে আজকাল এসব বই একলা পড়তে গেলে কেমন অস্থির লাগে। ইচ্ছে হয় সবাইকে জোর করে ধরে বসিয়ে ক্লাস নেয়, মাস্টারদা আর নেতাজীর জীবনী পড়ে শোনায়। বিএ পাশ দিয়ে গ্রামে গিয়ে মাস্টারি শুরু করবে নাকি? ভাবনায় হবু শিক্ষকের চোখের পাতা পিটপিট করে।
ভেবে দেখলে, গ্রামে যাওয়াই ভালো। অমার্জিত অগোছালো মুখের কথায় ভরপুর, সবল জঙ্ঘা সম্বল করে চড়াই পেরিয়ে আসা, টুইলের শার্টে ঘামের গন্ধ সাথে আনা উৎসুক মুখের পাহাড়ি শিশুদের পড়াতে মঞ্জুর কখনো ক্লান্ত লাগবে না। আর তাছাড়া গ্রামের মানুষ এখনো স্বার্থ বুঝতে শেখেনি, ব্যক্তিগত লাভের জন্য মুখ বুজে এরা অন্যায় পাশ কাটায় না। অনেক তো দেখা হলো। কই, মিটিং করার সময় বারবার ডেকেও তো একটা শহুরে, কথিত শিক্ষিত ছেলেকে পাওয়া গেলো না! সব শালা অজুহাত দেখিয়ে সরে পড়লো। মিটিং-এ সত্যিকার অর্থে আসলে সাড়া দিয়েছে ওই গ্রাম থেকে আসা ছেলেরাই। মঞ্জুর মত এরাও কাপ্তাই ড্যামের ভয়ংকর রুপটা নিজ চোখে দেখেছে, পাকিস্তান সরকার ওদের কীভাবে বঞ্চিত করেছে তা ওরা জানে। শহরের ঘি খেয়ে পাছা ফুলানোর সুযোগ এদের আসেনি বলেই কাজ করবার জন্যে, আন্দোলন করবার জন্যে এরা আদর্শ। মাস্টারি পেশার ফাঁকে এদের নিয়েই গ্রামে গ্রামে, পাহাড়ে পাহাড়ে ঘুরে জুম্মদের সচেতন করে তুলবে মঞ্জু। জানাবে, সরকার কীভাবে অবিচার করেছে ওদের সাথে। হিসাব নিকাশ করে দেখাবে, স্থানীয় অসৎ কর্তৃপক্ষ ওদের পুনর্বাসনের বাজেট থেকে কতটা মেরে দিয়েছে। তবে অতিরিক্ত পরিশ্রম করে অসুখবিসুখে পড়লে আবার বিপদ, সেরকম হলে পাহাড়ে ঘোরা বন্ধ করে কেবল শিক্ষকতাকেই আঁকড়ে ধরা ছাড়া আর রাস্তা থাকবে না! অসুস্থ হয়ে মঞ্জু দাঁড়িয়ে আছে কোনো স্কুলের বারান্দায় আর তার প্রস্তুত করা লিফলেট সরকারের সমস্ত মিথ্যাচার তুলে ধরে আছে ছাত্রদের হাত ঘুরে চলে যাচ্ছে পাহাড়ের গভীর থেকে গহীনে, ঝরনা থেকে ঝরনায়; চমৎকার এই কল্পনাটা দানা বাঁধতে গিয়েও ফট করে ফেটে যায় লিফলেট প্রসঙ্গে।
লিফলেটের ভাষা কি বেশি কড়া হয়ে গেছে? নইলে জ্ঞানেন্দ্র, প্রদ্যুৎ এরা এমন ঘাবড়ে গেলো কেনো? নাহ, স্মৃতি থেকে দুয়েকবার রিভাইজ দিয়েও মঞ্জুর তেমন কিছু মনে হয় না। দাবি তো তাদের খুব স্পষ্ট। কাপ্তাই বাঁধের জল রাখতে হবে ষাট ফুটের নিচে, ক্ষতিপূরণের জন্যে বরাদ্দ অর্থের সব ঠিক মতো দিতে হবে, পরিকল্পিত পুনর্বাসন করতে হবে- ব্যাস, হয়ে গেলো।
কিন্তু জ্ঞানেন্দুরা এই লিফলেট দেখেই একেবারে খেপে গেলো সেদিন, মঞ্জুকে একরকম চেপে ধরে মনোজের সাথে কথা বলতে নিয়ে গেলো সেই শ্রীপুর পর্যন্ত। ভাষা নাকি অ্যাতো আক্রমণাত্বক হয়েছে যে সরকারের হাতে এ জিনিস যাওয়া মাত্র ওদের গ্রেপ্তার অবশ্যম্ভাবী। মঞ্জুর অসহ্য লাগে এসব। রাজনীতি এদের কাছে চায়ের দোকান, বড়জোর কলেজের কম্পাউন্ডে গলা পরিষ্কার করার ওষুধ। আরে চকবাজারের মোড় থেকে সুগন্ধী কেনার মতো আরামে কি অধিকার আদায় হয়? এসব কথা যে এরা কবে বুঝবে!
আবার ওই টিকটিকিদের কাছ থেকেও সাবধান থাকতে হবে। নিজেকে নিয়ে মঞ্জুর চিন্তা বেশি নয়, কিন্তু ভাবনা হয় পার্টির অন্য ডেডিকেটেড ছেলেদের জন্যে। আইয়ূব খান এদের আটকে ফেলতে পারলে সরল- নিরক্ষর জুম্মদের সচেতন করবে কারা? আজ হোক কাল হোক, পুলিশের কাছ থেকে তো এসব চিরদিন লুকানো যাবে না। তার চেয়ে পাহাড়ি ছাত্র সমিতির আসল আস্তানা শ্রীপুর হোস্টেলের ছেলেদের অ্যালার্ট করে দেয়া যায়। গোপন ইনফরমেশনসহ কাগজপত্র কিছু থাকলে সেগুলা পুড়িয়ে ফেলুক। বোকার মতো ধরা দিয়ে লাভ কী, এখনো অনেক কাজ বাকি। তবে আপাতত চন্দ্রঘোনা মিলের চারুবিকাশ আর ধর্মদর্শীকে চিঠি দেয়া দরকার। লিফলেট বাহক হিসেবে নতুন যে ছেলেদের পাঠানো হবে, তাদের দায়িত্বটা নির্দিষ্ট করে দিতে পারলে চিন্তাটা খানিক কমে।
বিছানা ছেড়ে মঞ্জু যায় পড়ার টেবিলে, পিঠ-সোজা শক্ত কাঠের চেয়ারে বসলে কোমরের কাছে একটু একটু টান পড়ে। আর চিঠি লিখতে কলম টেনে নেয়া মাত্রই মহাপুরম গ্রাম মশা হয়ে কামড়াতে থাকে আবার। উপরে এবং ডানে মার্জিন দেয়া দিস্তা কাগজের তোড়া সেলাই করে বানানো খাতার উপরে তখন কালো কালিতে মঞ্জুর নাম আর শিক্ষাবর্ষ দুলতে থাকে পেন্ডুলামের গতিতে। মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা আর এক-নয়-ছয়-দুই সংখাগুলোর কাঁপাকাঁপি এমন বাড়ে; যে মনে হয় শেকলে বানানো মাওরুম নদীর সেতুটা আজও মানুষের ভয়ে কেঁপে চলেছে।
নাচতে থাকা অক্ষরগুলোর দিকে তাকিয়ে মঞ্জু কোত্থেকে যে চিঠি লেখা আরম্ভ করবে তাই ভুলে বসে থাকে। অথচ কত কত কাজ তাকে করতে হবে, এই ভেবে সে শান্তিও পায় না এতটুকু।