'ইউপিডিএফ যেটা, সেটা আসলে আগে ছিলো পাহাড়ি গণ পরিষদ।' অত্র এলাকার রাজনৈতিক দলগুলোর ইতিহাস বিষয়ে বলতে গিয়ে রাশেদের গলা এখন ভারি। 'ব্যাপার হচ্ছে কী, শান্তিচুক্তি হওয়ার আগে থেকেই পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ, পাহাড়ি গণ পরিষদ, হিল উইমেন্স ফেডারেশন- এরা সবাই চুক্তির বিরোধিতা করতেছিলো। তাদের বক্তব্য ছিলো, এই চুক্তি পাহাড়ের মানুষের আসল দাবি রিফ্লেক্ট করে না।'
শুনতে শুনতে আরিফ আড়চোখে একবার হিমেলের দিকে তাকায়। অনেকগুলো জরিপের ফলাফল সামনে রেখে ছেলেটা এখন ল্যাপটপে হাত চালাচ্ছে, চলমান বক্তব্যের দিকে তার মনোযোগ কম। অবশ্য মাঠ পর্যায়ে গ্রহণ করা জরিপগুলো থেকে পাই চার্ট বা ডাটা টেবিল বানানোর কাজটা আসলেই খুব হেকটিক, হাত আর পিঠের খবর হয়ে যায়। সাথে আবার ভুল না করার বিষয়েও সতর্ক থাকা লাগে।
হিমেলের দিকে খেয়াল করে রাশেদের গলাও একটু ঝিমিয়ে আসে। '... তো এই সংগঠনগুলা করলো কী, চুক্তি বর্জন করে পুরোপুরি স্বায়ত্ত্বশাসন চেয়ে আন্দোলন শুরু করলো। ইভেন খাগড়াছড়ি স্টেডিয়ামে যখন শান্তিবাহিনীর আর্মস সারেন্ডার অনুষ্ঠান চলতেছিলো, ওইখানেও তারা আপত্তি জানায়। ব্যানার-ট্যানার নিয়ে প্রতিবাদ করে। পাহাড়ি গণপরিষদের তখনকার যিনি সভাপতি ছিলেন- প্রসিত বিকাশ খীসা- উনি চুক্তির পরপরই নতুন পার্টি হিসেবে ইউপিডিএফ তৈরি করলেন। পিসিপি আর হিল উইমেন্স ফেডারেশনও সেই নাইন্টি এইট থেকেই ইউপিডিএফের সাথে কাজ করতেছে।'
খাগড়াছড়ি স্টেডিয়ামের সবুজ ঘাসের ওপর সারি বিছিয়ে বসানো কাঠের ফোল্ডিং চেয়ার, সবগুলো দখল করে বসে আছে শান্তিবাহিনীর সদস্যরা। আরিফ অনেক দূর থেকে এদের দেখতে পায়। আরো দেখে যে আত্মসমর্পণ করতে যাওয়া এসব গেরিলাদের দুপাশে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর গর্বিত সব সৈনিক। কিন্তু উপস্থিত সকলের মুখের বিরক্তিকে ঢেকে দিচ্ছে পাহাড়ি গণপরিষদের চুক্তিবিরোধী চিৎকার। প্রতিবাদের ভাষাটা অবশ্য এখান থেকে ঠিক কানে আসছে না। আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানের বিবিধ ফটোগ্রাফ দর্শনের অভিজ্ঞতার সাথে রাশেদের বর্ণনা মিলেমিশে গিয়ে আরিফের স্মৃতি এখন কাঁচির নিচে, মাথা তার ঠিকমতো কাজ করে না। অস্পষ্ট মেমোরি নিয়ে আরিফের তাই এলোমেলো লাগে, সে চেষ্টা করে রাশেদের কথায় মনোযোগ বাড়াতে। আরেকটু শুনলে মাথার ভেতরটা পরিষ্কার হতে পারে।
ইউপিডিএফ কি চায়? এ প্রশ্নের উত্তরে রাশেদ জানায় যে দলটার দাবি হলো প্রাদেশিক পূর্ণ স্বায়ত্ত্বশাসন। মুদ্রা-প্রতিরক্ষা-পররাষ্ট্রের মতো কয়েকটা বিষয় বাদ দিলে অন্য বিষয়গুলোতে তারা প্রদেশের পূর্ণ ক্ষমতা দাবি করে। তো ইউপিডিএফ-এর এসব দাবি নিয়ে আলোচনা হতেই পারে, তাতে রাশেদ কোনো সমস্যা দেখে না। কিন্তু চিন্তার ব্যাপার হলো, চুক্তি সই করার সাথে সাথেই এভাবে দুটো দল হয়ে যাওয়ায় সবচেয়ে বড় ক্ষতিটা আসলে হয়েছে পাহাড়ের সাধারণ মানুষের, তাদের শক্তি হয়ে গেছে অর্ধেক। খর্বিত শক্তি নিয়ে নিয়মতান্ত্রিক দাবি পেশ করাটা তাদের জন্য হয়ে গেছে আরো কঠিন। আর ভ্রাতৃঘাতী সংঘাতের নামে গত দেড়যুগে ইউপিডিএফ আর জেএসএস-এর কত কর্মী যে মারা গেছে, রাশেদ তো রাশেদ, পার্টিগুলোর নেতারাও কি তা হিসাব রাখে? নিজেদের মাঝে মারামারিতে এই পার্টিজানরা এমন ব্যস্ত যে পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নে সরকারকে প্রেশার দেওয়াটাও আজকাল এদের ঠিক হয়ে উঠছে না।
ল্যাপটপের ওপর থেকে হিমেল নিজের হাতজোড়াকে খানিক বিশ্রাম দিচ্ছিলো, ভ্রাতৃঘাতী সংঘাতের প্রসঙ্গ কানে আসলে সে বিরতিটা আরো দীর্ঘায়িত করে।
কথা রাশেদ খুব একটা খারাপ বলেনি, আপা আর ম্যাডামের ছেলেদের চাইতে এদিকের এরাই বা কম কীসে? ফেসবুকে গালিগালাজ থেকে বাস্তবের রাস্তায় পরষ্পরের বিরোধিতা করায় এদের যত উৎসাহ, রাষ্ট্রের দমননীতির বিপক্ষে তেমন জোশ কিন্তু মোটেই দেখা যায় না। হিমেলরা তো সব পক্ষের সাথেই আলাদাভাবে কথা বলেছে। তথ্য সংগ্রহের কথা বলে আলোচনায় যা শুনেছে, তাতে করে বৃহত্তর স্বার্থে ঐক্যের ব্যাপারে খুব বেশি আশাবাদী হওয়া যাচ্ছে না।
তরুণ রাজনৈতিক কর্মীদের ক্ষোভে তপ্ত সব বাক্য এখন হিমেলের মাথায় ঘুরপাক খায়।
'শুনেন ভাই, ওদের ইতিহাস যদি জানেন, তাহলে বুঝবেন যে ওরা আসলে একটা বুড়া বাঘ।'মোক্ষম একটি উপমা প্রয়োগ করার আনন্দে জনৈক রাজনৈতিক কর্মী উত্তেজিতভাবে হস্ত সঞ্চালন করছিলো। 'বয়স হইলে বাঘের যেমন ক্ষমতা থাকে না, খালি হুংকার ছাড়ে- ওদের অবস্থা এখন হইছে যে সেই রকম! ইতেরা এখন শুধু ক্ষমতার তোয়াজ করতেছে। পাহাড়ের মানুষ কী পাইলো না পাইলো, সেইটা নি ওদের চিন্তা নাই।'
কর্মক্ষমতায় মরিচা ধরে যাওয়া অপরপক্ষের কথায়ও একইরকম টোন।' ... ওরা আবার একটা পার্টি হইলো নাকি? শুদু ইস্যুভিত্তিক কাজ করলে কোনো পলিটিকাল পার্টি দাঁড়ায়? কোনো লংটার্ম প্ল্যান নাই, কোনো রোডম্যাপ নাই, খালি পারে যে সমালোচনা করতে। একদিকে চুক্তির বিরোধিতা করে, আবার চান্স পাইলেই আমাদের কর্মী-সমর্থকদের ধরি ধরি মারি ফ্যালায়!'
কারো ধারণা কেবল তার দলটিই শুধু পাহাড়ের জনণের মুক্তির জন্য কাজ করছে। 'ইতেরা কি ভাবে যে পাহাড়ের মানুষ বোকা? জনগণ পলিটিক্স বুঝে না?...ওই পার্টি পাহাড়ের মানুষকে আইজ পর্যন্ত কিছু দিতে পারে নাই। বিশ্বাসঘাতকতা করছে যে শুধু!'
কেউ আবার অন্য দলের সদস্যদের নৈতিক চরিত্র নিয়ে সোচ্চার। 'আরে ওদের নেতারা আছে শুধু নিজেদের ধান্দা করতে ব্যস্ত! তাদের বহু নেতা আছে দেখবেন পার্টি ছেড়ে দিয়ে বিদেশ গ্যাছে। কেউ কেউ আবার আমাদের পার্টিতেও চলে আসছে। ওদের চেয়ে আমাদের পার্টি তো অনেক পুরানো, কিন্তু আমাদের মধ্যে কি এরকম ডিস-অর্গানাইজড কিছু দেকছেন?'
পরষ্পরবিরোধী এসব বক্তব্য সে রিপোর্টে কীভাবে সামারাইজ করবে, তাই নিয়ে হিমেল খুব প্যাঁচে পড়ে গেছিলো। রাশেদের কথা শুনতে শুনতে মাথায় তার সেই জটিলতা পুনরায় ফেরত আসে। অস্বস্তিও লাগে একটু। একটা সিগারেট ধরাবে নাকি? না, থাক। রেস্ট হাউজের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ঘরে সিগারেট ধরানোটা ঠিক হবে না, স্মোক করতে হলে যেতে হবে রুমের পেছনের বারান্দায়। এই গরমের মাঝে সেটা করতে ইচ্ছে করছে না। এমনিতে হিমেল কিন্তু রেগুলার খায় না, ইচ্ছে করলে সামান্য টান মারে। তবে নিয়মের ব্যতিক্রম হচ্ছে বলে পাহাড়ে আসার পর পরিমাণটা সামান্য বেড়েছে।
'এম এন লারমা পার্টি বলে জনসংহতি সমিতির আরেকটা গ্রুপ আছে না?' আরিফ প্রশ্ন করে। সে ঠিকই মনোযোগ দিয়ে বক্তব্য শুনছে। 'ওই কেয়ার-টেকার গভমেন্টের সময় যেটা ফর্ম করছিলো?'
'আছে। মূল জেএসএস থেকে কিছু লোক বের হয়ে নতুন একটা দল করছেন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহিতি সমিতি-এম এন লারমা নামে।'
খাটের কোণা থেকে পা দোলাতে দোলাতে রাশেদ বিস্তারিত বলে। জনসংহতি সমিতি (এম এন লারমা) দলটার জন্ম হয়েছিলো তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কালে। তখন তো পাহাড়ে প্রকাশ্য রাজনৈতিক কর্মকান্ড একরকম স্তিমিত। তার মাঝেই মূল জেএসএস'এর কিছু কেন্দ্রীয় নেতা সন্তু লারমার প্রতি অনাস্থা জ্ঞাপণ করে নতুন দলটা বানায়। জেএসএস (সংস্কার) নামেও পরিচিত এই পার্টির দাবি, প্রয়াত এম এন লারমার দেখানো পথ থেকে বর্তমান জনসংহতি সমিতি বিচ্যুত। অতএব মহান সেই নেতার আদর্শ অনুযায়ী রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতেই নতুন একটি দলের সৃষ্টি। অন্যদের তুলনায় এই দলটি আয়তনে খুব বড় নয়, এরাও শান্তিচুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন চায়। তা একই জিনিস চাইলে তার জন্য দুটো দল ক্যানো করতে হবে, এই ব্যপারটা অবশ্য রাশেদ বোঝে না। এ প্রসঙ্গে সে তাই হালকা বিরক্তিই প্রকাশ করে,'হয়তো দেখবেন এই দলগুলা ভাইঙ্গেও আরো কোনো দল হবে! অলরেডি তো শুনতেসি আরেকটা সংস্কার পার্টি ফর্ম করা হইছে।'
সিগারেটের জন্য তৃষ্ণাটা ক্রমশ বাড়তে থাকলে হিমেল এবার ল্যাপটপটা ভাঁজ করে চেয়ার ছেড়ে জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। এসি চলছে বলে পর্দাগুলো আংশিক টানা, ঘরের ভেতরটা জায়গায় জায়গায় আলোতে থইথই। বাইরে উজ্জ্বল রোদ, বের হলেই তাপে ঝলসে যেতে হবে। শালার এক সপ্তাহের মাঝেই গরম কীরকম বেড়ে গেছে! নাকি ফিরে এসেছে বলে রাঙামাটি ওদের ওপর রাগ করলো? কিন্তু লংগদুতে ওরকম একটা ঘটনা হয়ে গেলো, এরপরে তো আর বান্দরবান বসে থাকা যায় না। বরং এখন লংগদুর লোকজনের সাথে কথা বলতে পারলে লাভ, ডকুমেন্টেশনটা জোরালো হয়।
জায়গা বদল করা হিমেলের দিকে একবার তাকিয়ে রাশেদ আবারো মনোযোগী শ্রোতা আরিফের দিকেই প্রায়োরিটি দেয়। 'এখানকার পলিটিক্স খুব ফ্লুয়িড,বুঝলেন? কন্সট্যান্ট চেইঞ্জ হইতেছে। আপনি কোনো মডেল ধরে আগাইতে পারবেন না। তার আগেই নতুন কোনো ফ্যাক্টর চলে আসবে।'
মৃদু হাসি দিলেও সাথে সাথেই পাহাড়ের রাজনীতির প্যাঁচালো সুতাগুলোর কথা ভেবে রাশেদ খুব চিন্তিত হয়ে যায়। সে বলে যে, চুক্তির পর একটা দল একেবারেই বৈষয়িক সুবিধার কাঙাল হয়ে পড়েছে। পূর্ণাঙ্গ চুক্তি বাস্তবায়নের যে নামকা ওয়াস্তে আন্দোলনটা তারা চালু রেখেছে, শক্তিহীনতার কারণে সেখানেও দলটা সুবিধা করতে পারছে না। মাঝে মধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রামের কোথাও সাম্প্রদায়িক সহিংস ঘটনা কী ভূমি দখল টাইপের কিছু হলে ঢাকা বা রাঙামাটিতে মানববন্ধন কিংবা বিক্ষোভ মিছিল করা পর্যন্তই এদের দৌড়। এর বাইরে কখনো মিডিয়ার সামনে চুক্তি বাস্তবায়নের আল্টিমেটাম দেওয়া, কখনো বা অসহযোগ আন্দোলনের ঘোষণা দিয়েও এরা তেমন কিছুই করতে পারে নাই। আর অন্য দলটা মুখে স্বায়ত্ত্বশাসনের জন্য দিনরাত চ্যাঁচালেও থাকে মূলত ইস্যুভিত্তিক আন্দোলন নিয়েই। হ্যাঁ, এই কথা রাশেদকে স্বীকার করতেই হবে যে, এই দলটা নানা ইস্যুতে চির সোচ্চার। কোথাও ধর্ষণ হয়েছে, কোথাও অমুক নেতা গ্রেপ্তারের প্রতিবাদ করতে হবে, কোথাও দাঙ্গা হয়েছে- প্রতিবাদে রাজপথে সবসময়েই এই দলটাকে পাওয়া গেছে। কিন্তু সমস্ত আন্দোলনের মূল উদ্দেশ্য হওয়া উচিৎ ছিলো শাসন ব্যবস্থার যে সংস্কার, তা নিয়ে প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী এবং বছরের মধ্যে দুয়েকবার আওয়াজ তোলা বাদে এদের কোনো মাথাব্যথা নাই। তো ইস্যুভিত্তিক আন্দোলনই যদি আসল হয়, তাহলে অন্যান্য সামাজিক সংগঠনগুলির সাথে এই দলের পার্থক্যটা থাকলো কোথায়?
বলতে বলতে রাশেদের সাহস বাড়ে, ফলে সে এবার সামাজিক সংগঠনগুলোকেও ধুয়ে দেয়। এখানকার প্রায় সমস্ত জাতিরই নিজস্ব স্টুডেন্টস ফোরাম বা এরকম অর্গানাইজেশন আছে। এদের কার্যক্রমও মোটামুটি এক - স্বজাতির প্রয়োজনে নানা ইস্যুতে সোচ্চার হওয়া আর দরকারে বিভিন্ন সময়ে তহবিল সংগ্রহ করে করা। কিন্তু বহুধা বিভক্ত পাহাড়িদের ঐক্যবদ্ধ হওয়ার কাজটা কি এই জাতিভিত্তিক সংগঠনগুলো আরো কঠিন করে দিচ্ছে না? এসব ব্যাপার ক্যানো যে পাহাড়িদের মাথায় আসে না- রাশেদ তা কিছুতেই অনুধাবন করতে পারে না।
সামষ্টিক ব্যর্থতার এসব গ্লানি শুনতে হিমেলেরও আর ভালো লাগে না। সে এবার এই আরামদায়ক এসি রুম থেকে ছুটে পালায় দূরের- বহূ দূরের কোনো মারমা গ্রামে। সদ্যই জায়গাটা থেকে ফিরেছে বলে পথঘাট চিনতে কোনো সমস্যা হয় না, ক্যাচিং ঘাট থেকে আরো ভেতরে হিমেল চলে যেতে পারে নির্দ্বিধায়।
বৃষ্টিতে পিচ্ছিল হয়ে যাওয়া পথ পাড়ি দিতে গিয়ে কেডসের তলায় কাদা লেগে একশেষ। গ্রামে ঢোকার ঠিক মুখেই একটা ছোট্টো ঝিরি। ঝিরির ধার ঘেঁষে কাদা দিয়ে হালকা বাঁধের মত করে ঘেরা দিয়ে তৈরি করা একটা জলাধার। যাত্রাশেষের ক্লান্তি গায়ে নিয়ে হিমেলরা যখন জলটা স্পর্শ করছে- তখন সন্ধ্যা নেমে গেছে। সঙ্গী মংক্ষিয়া মারমা এবার হাত তুলে ঝিরির কোণায় একটা গাছকে দেখায়। বলে, যে গ্রামবাসীরা এই গাছকে পূজো করে। হিমেলদের মতো বাইরে থেকে আগত ব্যক্তিদের সাথে যদি কোনো অশুভশক্তি থাকে, তাহলে গ্রামে ঢোকার আগেই এই গাছ সেটার ব্যবস্থা করে। অনেক গ্রামেরই প্রবেশ-মুখে এবং বের হওয়ার পথে এরকম একটা করে গাছ আছে। গাছগুলো আসলে বলতে গেলে গ্রামের একরকম রক্ষক, পূজার বিনিময়ে গ্রামবাসীকে রক্ষা করে।
অলৌকিকে বিন্দুমাত্র আস্থা হিমেলের নাই। গভীর রাতে লোডশেডিং হলেও ঘুম ভেঙে কখনো তার ভয় লাগেনি। কিন্তু মারমা পাড়ায় সে রাতটা গভীর হলে মংক্ষিয়ার মুখে গ্রামের সমস্ত অতিপ্রাকৃত শক্তির বর্ণনা শুনে ঢাকার রাস্তার অলিগলি দাপানো হিমেলের বুকে কাঁপন ধরেছিলো। নাকি সেই কাঁপুনির জন্ম গহীন পাহাড়ে বমদের সাথে রাত কাটানোর স্মৃতি মুহুর্তের জন্য ঝাঁকি দিয়ে যাওয়ায়? এখন কিন্তু সব মনে পড়ে যাচ্ছে। বম পাড়ায় ওদের চোখের সামনেই জাদুটোনার কারণে অসুস্থ হয়ে পড়া এক লোকের চিকিৎসা করতে বসেছিলো গ্রাম্য ওঝা। সমবেত জনতা এবং ভূত তাড়াতে আসা ওঝা, সকলেরই স্থির বিশ্বাস- রোগীকে কাবু করেছে বেড়ালের রুপ ধরে আসা শিশি নামের এক অপদেবতা। কিন্তু ওই অপদেবতাকে কে লেলিয়ে দিয়েছে- সেটা জানতেই হিমেলদের সাক্ষী রেখে ওঝা নানারকম ওস্তাদি প্রদর্শন করে। কখনো রোগীর পায়ে সে পিঁয়াজ লাগায়, কখনো আবার চুলের গোছা কেটে গরম পানিতে ফেলে সিদ্ধ করবার জন্য। বম ওঝার স্মৃতি মনে পড়তেই যেন, মংক্ষিয়ার বর্ণিত সমস্ত রাগী দেবতা সারাটা রাত ঘুমের মাঝে হিমেলকে ভয় দেখায়।
ওই রাতের দেড় সপ্তাহ পরের রাঙামাটির রেস্ট হাউজ বসেও এখন হিমেলের ঘোর কাটে না। তাকে অভিভূত করে রাখে বমদের যাপিত আশ্চর্য নিরবিচ্ছিন্ন শান্তির জীবন। পূর্বপুরুষরা শিকার করার পেশা ছেড়ে বমরা এখন ধরেছে কৃষিকাজ। সিনেমায় দেখা মধ্যযুগের কোনো পাহাড়ি গ্রামকে মনে করিয়ে দিতে তাদেরও আছে একাধিক মিশনারি চার্চ। রাজনীতি বা রাষ্ট্রের মতো ভারি জিনিস নিয়ে ওখানে কারো মাথাব্যথাই নাই। পৃথিবীর সমস্ত অবসর আর সরলতা নিয়ে এসব মানুষ কী করে আজও বেঁচে আছে, ভেবে হিমেল কূল পায় না। আচ্ছা, রবার্ট ব্রুসের দেশে গিয়েও কি সে এরকম মানুষের দেখা পাবে? সন্দেহ আছে। পুরোনো দিনের রাজপ্রাসাদ ধাঁচের ম্যানর বা ব্যাগপাইপ বাজানো বাদকদল ছাড়া স্কটল্যান্ডে আর আছেটা কী? বান্দরবানের ভূতগ্রস্থ পাহাড়ের সাথে গ্লাসগোর পপলার গাছ শোভিত ক্যাম্পাসের তুলনা করে হিমেলের মনটা এখন হঠাৎ খারাপ হয়ে যায়।
তবে হিমেলের বিক্ষিপ্ত ভাব পুষিয়ে দিতে আরিফের মনোযোগ আজ দ্বিগুণ। সারাজীবন পলিটিক্স এড়িয়ে আসা তার মগজ এখন স্থানীয় হালচাল বুঝে উঠতে কঠোর পরিশ্রম করছে। 'আরেকটা কথা আমারে বলেন তো, এই যে কালকেও যেমন অনলাইনে কী এক পত্রিকার পাতায় দেখলাম, যে পাহাড়ে লাখ লাখ আদিবাসীকে নাকি খ্রিস্টান বানায় ফেলা হচ্ছে! এইগুলা কী সত্য নাকি ভাই?'
'অমর্ত্য সেনের 'পোভার্টি এন্ড ফেমিন' পড়ছেন?'
নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদের রচনা আরিফের পড়া হয়নি। কিন্তু এর সাথে বান্দরবানের লোকেদের খ্রিস্টান বানানোর সম্পর্ক কী? প্রশ্নটা শুনে রাশেদ মুচকি হাসে, তারপর ভারী স্বরে সতর্ক বাক্যবিন্যাসে অমর্ত্য সেনের বক্তব্য ব্যাখ্যা করে ব্যাপারটা ক্লিয়ার করতে চায়। 'বিষয়টা হইতেছে, অংশগ্রহণমূলক গণতন্ত্রের অভাব। অমর্ত্য বলছেন যে, যেসব দেশে অংশগ্রহণমূলক গণতন্ত্র আছে, কর্তৃপক্ষ কেন্দ্র থেকে গণমানুষকে বিচ্ছিন্ন করে রাখে না- ওইসব অঞ্চলে কখনো দুর্ভিক্ষ হয় না। ইতিহাসেও দেখবেন যে - একনায়কতন্ত্র, রাজতন্ত্র, তারপর আপনার ঔপনিবেশিক শাসনব্যবস্থা যে সব জায়গায় ছিলো, শুধু সেই সব দেশেই কেবল দুর্ভিক্ষ হইছে। খেয়াল করে দেখেন, বান্দরবান বা থানচিতে কিন্তু এখনো দুর্ভিক্ষ হয়, এর মানে কী?'
মানেটা বোঝাতে গিয়ে রাশেদ নিজেই এগিয়ে আসে। ব্যাপারটা হচ্ছে যে, এই এলাকাগুলো এখনো কেন্দ্র থেকে একরকম বিচ্ছিন্ন। আর এসব এলাকাতে তৃতীয় পক্ষের কেউ এসে যদি রাষ্ট্রের মতো করে কিছু সুবিধা দেয় স্থানীয় লোকেদের- তখনই গড়ে ওঠে রাষ্ট্রের মাঝে রাষ্ট্র, ফ্র্যাঞ্চাইজ স্টেট। 'এনজিওগুলা কি এই সুযোগ ছাড়বে নাকি? কর্তৃপক্ষ হাত গুটায়ে বইসে থাকবে, অন্যরা এই সুবিধা নিবে না?'
শুনে বিধর্মী এনজিও'দের ওপর রাগ করবে কি না- সেটা আরিফ স্থির করতে পারে না, আর সেই অবসরে পৌরনীতির অব্যবস্থাপনা ছেড়ে রাশেদ চলে যায় ইতিহাসে। এই যে আদিবাসীরা, ধর্মান্তরিত হওয়ার আগে ছিল মূলত হান্টার-গ্যাদারার, শিকার করা জন্তু ভাগাভাগি করেই এরা জীবনধারণ করতো। প্রকৃতি পূজা ছিলো তাদের ধর্ম, জমির মালিকানা ব্যবস্থার কোনো বালাই ছিলো না। কিন্তু এই যুগে কি আর এটা সম্ভব? রাষ্ট্রপ্রথা চলে এসেছে, সীমান্তের ধারণা চলে এসেছে; এক জায়গার শিকার শেষ হলে অন্যত্র যাবার কোনো উপায় আর এখন নাই। 'এইদিকে ঘুরঘুর করলে বিজিবি ধরবে, আবার ওইদিকে গেলে বিএসএফ গুলি করে মারবে- মানুষগুলা তো কোনোভাবেই বাঁচতে পারবে না!'
মানুষ বাঁচানোর দিকে রাশেদের খুব খেয়াল। আর কিছু না হোক, একটা প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মে দীক্ষিত হওয়ার ফলে প্রান্তিক এলাকার আদিবাসীদের মাঝে জমির মালিকানা প্রথার কিছুটা হলেও চালু হয়েছে। স্থায়ী বসতি গড়ার প্রয়োজনে শিকারের বদলে শুরু হয়েছে চাষাবাদ। এসব পরিবর্তন যে এই আদিবাসীদের বিলুপ্ত হওয়া থেকে আপাতত বাঁচিয়েছে, রাশেদ তা অকুণ্ঠচিত্তে স্বীকার করে। কিন্তু বাঙালির স্বভাবচরিত্র তার একেবারে বরদাশত হয় না। এরা তো মানুষ না! মানুষের বাচ্চা হলে কেউ দুর্ভিক্ষ পীড়িত আদিবাসীর চেয়ে খ্রিস্টান হয়ে যাওয়া আদিবাসীদের নিয়ে বেশি চিন্তিত হতে পারে? বরং নানা ধরনের সুবিধা থেকে বঞ্চিত আদিবাসীদের জন্য চাকুরিতে যে কোটা দেয়া হয়, সেটাও নাকি আজকাল লোকে তুলে দিতে চায়! এদের ওপর রাশেদ তাই খুব বিরক্ত। 'এই যে লংগদুতে এতো বড় একটা ঘটনা হয়ে গেলো, দেখছেন তা নিয়ে কোথাও আলোচনা হইতে? কারো কোনো মাথাব্যাথা আছে?'
শেষ কথাটায় আরিফ একটু লজ্জা পায়। রাশেদের আক্ষেপ তো সত্যি, অনলাইনে সারাদিন কত কিছু নিয়ে মাতামাতি হয়, কিন্তু লংগদুর ব্যাপারটায় তো কাউকেই খুব বেশি কথা বলতে দেখা গেলো না। এমন কী জাতীয় দৈনিকগুলোর প্রতিক্রিয়ার স্বরও যথেষ্ট নিচু। অথচ দিন পাঁচেক আগের এই ঘটনায় স্থানীয় আদিবাসী, বাঙালি অথবা প্রশাসন- সব পক্ষই এখন অশান্ত এবং আলোড়িত। আরিফরা পর্যন্ত ওদের বান্দরবানের সফর সংক্ষিপ্ত করে এই ব্যাপারটা খতিয়ে দেখতে রাঙামাটি ব্যাক করলো।
সংক্ষেপে বলতে গেলে, বৈঠা দলের ইউনিয়ন পর্যায়ের সাংগঠনিক সম্পাদকের লাশ পাওয়া গেলো রাস্তার পাশের জঙ্গল থেকে, আর সেই ঘটনাকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট উত্তেজনায় লংগদু উপজেলার চারটা গ্রামে পোড়ানো হলো পাহাড়িদের অন্তত দুইশো বাড়ি। ক্ষতিগ্রন্ত গ্রামগুলোর শতাধিক পরিবার পালিয়ে এখন আশপাশের বনজঙ্গলে আশ্রয় নিয়েছে। মাঝে দুইদিন টানা বৃষ্টি পড়েছে, তবুও নিরাপত্তা-শঙ্কার কারণে গতকাল পর্যন্ত বেশিরভাগ পরিবার গ্রামে ফেরেনি। আরিফরাও ফিরেছে আসলে কাজের টানে, দ্রুত ওই এলাকায় গেলে লোকজনের কাছ থেকে টাটকা সব তথ্য সংগ্রহ করা সম্ভব। এরকম সুযোগ তো আর চট করে পাওয়া যায় না!
কিন্তু আরিফের সংকোচ লাগে, ক্ষতিগ্রস্ত ওসব পরিবারের সামনে গিয়ে সে কী প্রশ্ন করবে? প্রজেক্টের কাজে ওরা পাহাড়ে এলো তো দেড় মাসও হয়নি, এর মাঝেই একবার খাগড়াছড়ি সদর- একবার লংগদু উপজেলায় এরকম ঘটনা ঘটতে দেখলো। কয়েক মাস বা বছর থাকলে আরও কত কী দেখতে হতো, কে জানে! আচ্ছা, সারা দেশেই তো ছিনতাই-খুন-জখম হয়, কিন্তু সন্ত্রাসীর ছুরিতে কেউ মারা গেলে লোকে তো গিয়ে সন্ত্রাসীর পুরো এলাকা পুড়িয়ে দেয় না? তাহলে শুধু পাহাড়েই কেবল সন্দেহের ওপর ভিত্তি করে ওরকম ঘটে ক্যানো!
চারদিকের বিদ্যমান দ্বন্দ্ব-সংঘাত-অবিশ্বাসের চক্র হতে মুক্তির জন্য আরিফের শরীর তেতে ওঠে। মাথার ভেতরটায় ক্যামন যেন বিস্ফোরণ হয়। মনে হয় হাজার হাজার মানুষ দৌড়ে আসছে হাতে মশাল নিয়ে, তাদের মুখ অস্পষ্ট- কিন্তু চোখের তারায় জিঘাংসা খুব প্রগাঢ়। শুয়োরের বাচ্চারা বোধহয় কোথাও আগুন দিতে যাচ্ছে। আরিফের খুব অসহায় লাগে, এদের সে আটকাবে কী করে? এদিক থেকে আবার মুনা হাত ধরে খুব ঝাঁকায়। বলে, 'কিছু একটা করো! আরে, আটকাও না ওদের! সবাইকে মেরে ফেলবে তো!'
মুনার এই ঘাবড়ে যাওয়া দেখে আরিফ হঠাৎ করে খুব সাহসী হয়ে যায়। মনে হয়, এখন সে সবকিছুকে রুখে দিতে পারে। নরম স্বরে মুনাকে 'কিছু হবে না, আমি তো আছি!' জাতীয় আশ্বাস দেয়ার জন্য আরিফ হয়ে ওঠে অস্থির। কিন্তু কোথায় মুনা? একটু খেয়াল করে তাকাতেই মেয়েটাকে আর খুঁজে পাওয়া যায় না। বাদবাকি হাজারো মানুষও রেস্টহাউজের এই বড়সড় ঘরটায় ওদের তিনজনকে রেখে কোথায় যেন উড়ে গেছে। নাহ, এবারও নিজের যোগ্যতা আর সাহসটা মুনার কাছে ঠিকমতো প্রদর্শন করা গেলো না। এই হতাশা আরিফকে এমন মরিয়া করে তুলে, যে নতুন করে পরীক্ষা দিতে সে উন্মুখ হয়ে ওঠে। 'আচ্ছা, কী ফিক্সড হইলো এখন লাস্টে? আমরা কি কালকে যাচ্ছি? এখনো তো কিছু ফাইনাল হইলো না!'
স্কটল্যান্ডের উঁচু-নিচু পাহাড়ি ভূমির মাঝে হিমেলের ইতস্তত ভ্রমণও এখন শেষ হয়েছে। আরিফের জিজ্ঞাসায় সাড়া দিয়ে সে বলে,'কালকে তো যাইতে হবেই!'
সিদ্ধান্তসূচক বাক্যটি উচ্চারণ করে খানিক পরে সে আবার জানায়, 'বিজয়ের প্রবলেম না থাকলে তো আজকেই চলে যাইতাম। ও আগে আসুক না ওর কাজ শেষ করে!'
ব্যাপারটা এবার আরিফেরও খেয়াল হয়। বিজয় তো ওদের পাড়ায় সেই ঝিরির পাথর রক্ষার ব্যাপারটা নিয়ে দারুণ ব্যস্ত, আজকে নাকি তার কী একটা প্রোগ্রাম আছে। আয়োজকদের মধ্যে আছে বলে বিজয়ের দায়িত্বও খানিক বেশি। সব শেষ করে আসতে ছেলেটার তাই অন্ততঃ বিকাল হয়ে যাবে।