নীলমুখী ঢেউ
ঘোড়াউত্রায় তখনও আগুনের উল্কি একেবারে মিলিয়ে যায়নি বরং ঢেউয়ের তালেতালে নাচের মুদ্রা নিয়ে সাপের সাথে গলাগলি করে চলে। আমরা তাদের দেখি আর অপেক্ষায় থাকি কালীপূজার। মন্দিরে আরতির সাথে সতিশের ধূপদানিসহ আঁকাবাঁকা শরীর তখন পুঁইশাকের কোমলতা নিয়ে লকলক করে, আগুনের রং নিয়ে পানির সাথে মিশে থাকে। আমরা এই ছেলের রূপ নিয়ে গবেষণা করি, কানাঘুষা করি। কেউ কেউ খেলার ছলে জড়ায়ে ধরি। পাশের গ্রাম থেকে আসে ডেঙ্গুর মগা। সতিশের দিকে লোলুপ চোখ নিয়ে তাকিয়ে থাকে। তাতে জেলেপাড়ার বউ-ঝিদের কিছুটা হলেও স্বস্তি হয়। পুরো গ্রামের অস্বস্তি তখন ভর করে সুখন্ত দাসের ঘাড়ে। মুখ ফুটে কিছু বলাও যায় না। বোঝা যায়, বলা যায় না - এই ফ্যাসাদের মধ্যে হাবুডুবু খেয়ে দিন যায় সুখন্তের। মাঝেমাঝে ভাবে, ছেলেকে ওর মাসীর বাড়ি গোপীনাথপুরে রেখে আসবে। কিন্তু সেখানেও কি কম জারজের আখড়া! কই যাই! ভগবানের দুনিয়া বরাবরই শাসন করলো পাণ্ডবরা! সুখন্তের বুক দুরুদুরু করে, ঘুম হারাম করে দেয়। ছেলেটার উপর এই জারজের নজর বাড়াবাড়ি রকমের। নানা উছিলায় বাড়ি আসে; ছেলেকে বিস্কুট, আইসক্রিম, লজেন্স কিনে দেয়; কোলে বসায়ে আদর করে। আর বলে, সুখন্তদা, এমন একটা ছেলের বাপ হইতে পারলে নিজেরে বড় ধন্য মনে করতাম। তুমি যে কি লাকি সুখন্তদা!
সুখন্ত ভাবে, এই বুঝি একটা কথা বলার সুযোগ পাওয়া গেল - এই ছেলেতো তোমারই ডেঙ্গুর ভাই, তুমি ওরে ছেলের মতো মনে কইরো, তাইলেই হইল।
ডেঙ্গুর হাসে, সাথে সুখন্তও হাসার চেষ্টা করে। সুখন্তের এই হাসিমুখে লেগে থাকে রাজ্যের অস্বস্তি আর দুশ্চিন্তা। ডেঙ্গুর মগারে এলাকার কাকপক্ষীও চেনে। ৩৫ বছরের এই খাটাস প্রায় ২০ বছরই ছিল জেলে। বছরের ৯ মাস থাকে জেলে আর ৩ মাসে কম কইরা হইলেও ৩ তিরিশে ৯০ জন লোকের সর্বনাশ করে আবার যায় জেলে। কারো কিছু বলার নাই, কারো কিছু করার নাই। পুলিশও কাহিল হয়ে গেছে। যার মান-ইজ্জতের ভয় নাই, জানের মায়া নাই তার সাথে কে যাইবো লাগতে? সবারইতো জানের মায়া আছে!
সুখন্তের চারদিক কেমন যেন ঝাপসা লাগে। সেই যে ছোটবেলায় কালিবাউসপুরের মন্দিরে দুপুরের রোদে পুড়তে পুড়তে হঠাৎ আন্ধারে হারায়ে গিয়ে পুরুতের হাতে ধরা পড়েছিল। পুরুত আদর করে-করে আরো আন্ধারে নিয়া গিয়া কয়, ‘তোরে আমি পেট ভইরা প্রসাদ খাওয়ামু সুখন্ত।’ ‘আমি প্রসাদ খাই না ঠাকুর, আমারে ছাইড়া দেন আমি বাড়ি যামু।’ সুখন্ত যতই কাঁদে পুরুত ততই জোরে জাপটায়ে ধরে। সুখন্তের সেই আন্ধার আর কাটলো না। ঘাড়ের মধ্যে পুরুতের শক্ত হাত, বুকের মধ্যে বরফ-শীতল আতঙ্ক ভাদরের গরমেও শরীরে কাঁপুনি তোলে। শীতল মৃত্যুর ভয় ঢুকিয়ে দেয় হাড্ডির ভিতর। সুখন্ত বিনা কারণেই একবার ঘরে আসে একবার বাইরে যায়। কিন্তু ছেলের দিকে চোখ-তুলে তাকাতে পারে না। ছেলে তখনও ভেঙ্গুরের কোলে বসা। সুখন্ত ছেঁড়া জালের দিকেই তাকিয়ে থাকে। হাঙ্গর না, কুমির না, সাপ না, বাঘ না, দুই হাতওয়ালা একটা মানুষের ভয়ে সুখন্তের গা কেমন কাঁটা দিয়ে ওঠে, শিরশির করে। সুখন্ত ছেঁড়া জাল সেলাই করা ভুলে গিয়ে কী এক জানা-অজানা আতঙ্কের মাঝে নিমজ্জিত হয়। দমফুটা লাগে। ছেঁড়া জাল ছিদ্র করে রাক্ষসী বোয়াল মাছের মতো দুনিয়াটা গিলে ফেলতে ইচ্ছা করে। সুখন্তের এই গিলে ফেলার ইচ্ছা শেষ পর্যন্ত চোখ তুলে তাকানোর সাহসে এসে ঠেকে। একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বলে, সতিশ তোর আজকা ইস্কুল নাই?
সতিশ কয়, আজকা ইস্কুলে যামু না, কাকু কয়ছে মাস্টাররে কয়ে দিবো। তাইলে ইস্কুলে না গেলেও পাশ।
ডেঙ্গুর সতিশের কথা শুনে শুয়োরের দাঁত বাইর কইরা হাসে। সুখন্ত এর উত্তরে কী বলবে খুঁজে পায় না। আঙ্গুলে পেঁচানো সুতার গিঁঠে কথা খোঁজে, পথ খোঁজে মন্দিরের কানাগলি থেকে বাইর হওয়ার।
আজ সবকিছু বড় নীরব। সুনশান নীরবতায় বসবাস করে পবন দেবতা। তেনার গম্ভীর মূর্তি মাকালীর অন্তরাত্মা করে কম্পিত। জেলেপাড়ার সবার শ্বাস উৎকণ্ঠায় অবরুদ্ধ। কিছু একটা ঘটার অজানা আশঙ্কায় বাকরুদ্ধ একটি চড়াইয়ের কিচিরমিচির শকুনের চিৎকার হয়ে কানে বাজে। বিকাল থেকে সন্ধ্যা ঈশান কোনার মিশকালো আন্ধারের সাথে নদীর আজব নীল মিশে তৈরী করে মহাপ্রলয়ের অশনিসংকেত। সবাই এই প্রলয়ের ইঙ্গিতে ম্রিয়মান হয়ে ঘরে বসে থাকলেও সতিশ - দুরন্ত সে রূপসীবালক তখনও ঘুড়ি নিয়ে দৌড়ে বেড়ায় ঘোড়াউত্রার পাড় ধরে। বাতাসবিহীন আকাশে ঘুড়ি ওড়ানোর কসরৎ করতে করতে কখন যেন পবন দেবতার দাক্ষিণ্য অর্জনে সক্ষম হয়। সতিশের সাদা ঘুড়ি ঘোড়ার পেখম তুলে উড়িয়ে নিয়ে যায় উত্তরের মিশকালো মেঘরাজি আরও উত্তরে অজানা পাহাড়ের দেশে। দক্ষিণের মৃদু বাতাসে ভেসে আসে সাদামেঘ, সোনালী ডানার চিল, সাদা ধবধবা বকের ঝাঁক। ঘোড়াউত্রার দুকূল প্লাবিত করে নেমে আসে আইনার কান্দি, ঋষিপাড়া, সাগরফেনা, শিবপুর, গোপীনাথপুর, আর তার পাশের কান্দাপাড়ার আবালবৃদ্ধবণিতা। সবাই যোগ দেয় সতিশের মেঘ-তাড়ানোর উৎসবে। পবন দেবতার মন্দিরে রাখে নৈবেদ্যের অর্ঘ্য। দেবতারা খুশী হয়। নেচে ওঠে ধরিত্রী। ধরিত্রীর সোনারঙ লাগে সবার গায়ে। সন্ধ্যার সোনালী আভা নিয়ে সবাই ঘরমুখী হয়। সন্ধ্যা নামে কাইমের বাউলি জেলেপাড়ায়। সন্ধ্যা নামে আকাশ থেকে কালো বিড়ালের রং নিয়ে। সন্ধ্যা নামে চরাচরের সব রং মুছে দিয়ে আতঙ্কের কালো রং ছড়িয়ে। রাত্রি আজ যতই মিশকালো অন্ধকারে জমে উঠুক না কেন মানুষের মনে যে সন্ধ্যার সোনারঙ তখনও আঠার মতো লেগে আছে! তাইতো কেউ খেয়ালই করলো না আজ রাত্রির রং কতটা কালো। কতটুকু ভয়ের রঙ মিশে আছে মন্দিরের পেছনের গাবগাছে। কূপপক্ষী আজ সন্ধ্যা না হতেই কেন শুরু করেছে মৃত্যুকে ডেকে আনার কুফা চিৎকার! কেন আজ সবাই ভুলে গেল সন্ধ্যাপ্রদীপ জ্বালাতে, কেন ভুলে গেল উলুধ্বনির শোরগোলে বরণ করতে মা-লক্ষ্মীকে! সেই কারণ সবাই জানে, কিন্তু মুখ খোলার সাহস কই! সবাই যে দুয়ার বন্ধ করায় ব্যস্ত! সবাই যে সোলার বেড়া আর ছনের ছাউনির নিরাপদ ডেরায় নিজ নিজ সন্তানের মুখপানে দৃষ্টি দিয়ে বসে! কেউ দেখুক আর না দেখুক, সবাই যেন কিভাবে জানে ডেঙ্গুর তার দলবল নিয়ে গ্রামে ঢুকেছে। ডেঙ্গুরের গ্রামে-ঢোকা যে কোন-না-কোন ছেলেমেয়ের সর্বনাশ তাতে কারও কোনো সন্দেহ নাই। এই ছোট্ট জেলেপাড়ায় মা-কালীর আশীর্বাদ আর মায়ের কোল ছাড়া আর যে কোনো নিরাপত্তা নাই। সেই কোল থেকেই কেউ-না-কেউ ছিনতাই হবে আজ রাতে। কেউ জানবে না কার হলো সর্বনাশ, কার মনমন্দিরা থেমে গেল চিরদিনের জন্যে। তারপরও জেলেনিরা বেঁচে থাকে; খায়-দায়, ঘর-সংসার করে, কিন্তু কোনদিন আর চোখ তুলে তাকাতে পারে না কোনো পুরুষের দিকে। এও এক জীবন, যে-জীবনে নাই কোনো স্বাদ-আহ্লাদ, নাই কোনো অনুভূতির অনুরণন। শুধু দুইবেলা কড়কড়ে মোটা ভাত আর বইচা মাছের ঝোল। শুধুই অন্ধকারে বলাৎকার, কুকুরীর মতো বাচ্চা বিয়ানো বছরের পর বছর। কেন বাঁচবে, কিভাবে বাঁচবে সেই প্রশ্ন বড়ই অবান্তর ঘোড়াউত্রার পাড়ে। এই গ্রামে একজনই এই প্রশ্ন উত্তাপন করেছিল, সে সতিশের মা মায়ারানী।
মায়ারানীকে সুখন্ত বিয়ে করে আনে সেই বড়পানির সনেরও আগে। তখন মেয়েটার বয়স আর কত, ১২ কি ১৩। সেই কী রূপযৌবন! যে দেখে সে-ই চোখ পোড়ায়। ভুলে যায় সামনে চলার গতি। জাওলাবাড়ির বউ কারও দেখতে তো কোনো অসুবিধা নাই। পাওয়ারফুল লোক হইলে তো ঘরের দাওয়ায় গিয়ে খোঁজখবর লয়, সুখন্তের সাথে গল্প করে। সুখন্ত না থাকলে বউদিকে বড় বেশী আপন মনে হয়। একটু বসে পান-তামুক তখন হয়ে পড়ে কুটুমবাড়ির অনবদ্য অংশ। আর মায়ারানীর তখনতো উঠতি যৌবনে সবে কিশোরী থেকে বিয়ের পানি লাগার কারণে দ্রুত জোয়ার। সারাক্ষণই হাসে, সারাক্ষণই কথা ফোটে খইয়ের মতো। যে আসে দাওয়ায় তার সাথেই ভাব, তার সাথেই কথা কয় প্রাণ খুলে। মায়ারানী তখন সবারই ভাবী, সবার স্বপ্নের ঘোর।
নাগর আসে আশপাশের প্রায় সব গ্রাম থেকেই। সুখন্তের নজর এড়ায় না। সুখন্তের বৃদ্ধ মা সারাক্ষণ চোখে-চোখে রাখে এই ষোড়শীকে। কারণে-অকারণে ডাকে ‘কই গেলি গো মায়া, এদিকে আয় তো লক্ষ্মী, একটু পানি খাওয়ায়ে যা।’ ‘কই গেলি গো মায়া, দেখতো আমার মাথায় মনে হয় উকুন হয়ছে, একটু দেখতো মা।’ ‘কই গেলি গো মায়ারানী, দেখতো দাওয়ার শুঁটকিগুলা মনে হয় কউয়া খাইলো। দেখ দেখ।’ বুড়ির এই খেঁচাল মায়ারানীর ভাল্লাগে না। সুখন্ত আগে দিনে বাড়ি থাকতো, রাতে যাইতো নদীতে মাছ ধরতে। আজকাল আর রাতে বাইর হওয়ার সাহস হয়না। রোজগারপাতি কম হলেও সে এখন দিনেই কাজ করে। বড়শী দিয়ে, জাল দিয়ে মাছ ধরে। তাতে মায়া খুশী। অন্তত বিছনায়তো ঘুমানো যায় নিশ্চিন্তে। প্রথম প্রথম খুব মন খারাপ হইত যখন সুখন্ত রাতের বেলায় মাছ ধরতে যেত। যদিও জেলের ঘরের মেয়ে মায়ারাণী জানতো যে, মাসের কয় রাত স্বামী ঘরে থাকবে, আর কয় রাত নদীতে। জেলেনীর জীবন জোয়ার-ভাটার উল্টা নিয়মে বাঁধা; যখন জোয়ার, স্বামী নদীতে; যখন ভাটা, স্বামী বিছনায়। তাই জোয়ারের পানি গড়ায় পড়ে এদিক-সেদিক। তাতে জোটে বনের মৌমাছি।
এমনই এক বনভোমর আসে কাইমের বাউলী গ্রামে। পাতা নাই, গাছ নাই, ফল নাই, ফুল নাই; সাগরের বুকে বালুয়-গড়া ঘরবাড়ির উপর ওড়ে চিলশকুনের চোখ। পাতাবিহীন এই গ্রামে গাছ বলতে দুই-একজনের আঙ্গিনায় লাউ বা কুমড়া, তাও শীতকালে। তাতে প্রজাপতি বা পাখির বদলে কীটপতঙ্গের আনাগোনাই বেশী। বর্ষা বা গ্রীষ্মকালে কেবল সায়রের ফোঁসফোঁসানি। কারণে-অকারণে ফুলে-ওঠা গঙ্গাদেবীর রুদ্ররোষ, মনসার রক্তচক্ষু, আর পবন দেবতার উথালপাথাল ঝাপটা ৪০ ঘরের এই গ্রামটাকে করে রাখে মরা গাছে চড়াইয়ের বাসা; সামান্য বাতাসেই ‘উড়ে-যাই উড়ে-যাই’ করে। কিন্তু কী এক আচম্বিত কারণে সে প্রকৃতিকে হার মানিয়ে লেগে থাকে চিকন কতকগুলো ডালপালাকে আঁকড়ে ধরে। কিন্তু মানুষের নিষ্ঠুরতার কাছে বারবারই পরাজিত হয়, ছিন্নভিন্ন হয়, লণ্ডভণ্ড হয় জেলেনীর সভ্রম; জেলেদের মৎস্যগন্ধা স্বপ্ন; সতিশের ঘুড়ি ও নাটাই; কালী-মন্দিরের ঘণ্টা আর উলুধ্বনি। পরাজিত হয়, ভেঙ্গে পড়ে, আবার উঠে দাঁড়ায় নতুন করে ভাঙ্গার প্রত্যয় নিয়ে। সুখন্তও জন্ম থেকে ভেঙ্গেভেঙ্গে এখন যেন অপেক্ষা করছে আবারও একবার ভেঙ্গে চিরদিনের জন্য শ্মশানের বালিতে মিশে যাওয়ার। ছোটবেলায় অন্ধকার মন্দিরে বলাৎকার, বুকের উপর থেকে মায়াকে নিয়ে গেল মতি চেয়ারম্যান। কেউ জানলও না। দুইরাত পর ফেরত দিয়ে গেল। তাও কেউ জানল না; এক সুখন্ত আর বুড়ি মা ছাড়া। মায়া ফেরত আসার পর চিরদিনের জন্যে বন্ধ হয়ে গেল তার হাসি, কথাবলা, আর উচ্ছলতার ঝলকানি। সাতদিন-সাতরাত কেবল ঘুমালো। ঘুম থেকে উঠে জল খায়, জল খেয়ে আবার ঘুমায়। মা মাঝে মাঝে জলের বদলে একটু দুধ তুলে দিতো। সুখন্ত আর কোনদিন মায়ার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়নি; কোনদিন আর চোখ তুলে দেখেনি মায়ার মায়াবী চোখ, লাবণ্যে ঢলঢলে লাউফুলের মতো নিষ্পাপ মুখ। কোনদিন আর মায়াকে আদর করে বুকে জড়াতে পারেনি সুখন্ত। কেন পারেনি তার ভেদ আজও সুখন্তের কাছে পরিষ্কার হলো না। সুখন্ততো মায়াকে একবারের জন্যেও ঘৃণা করেনি! একবারের জন্যেও মনে হয়নি মায়া দোষী! বরং নিজের কাপুরুষতার গ্লানি, বেঁচে থাকার লজ্জা, অসহায়তার কষ্ট, রাগ-দুঃখ-অপমানের যন্ত্রণায় উপরের পাটি দাঁতে পিষে ফেলে নিচের পাটির সবগুলো দাঁত। ঘটনার পর সুখন্ত ভয়ে-না-লজ্জায় নদীর পাড়ে আর যায়নি। নদীর জল ছোঁয়নি দিনের বেলায়। নিজের এই বিকৃত মুখ যেন কেউ না দেখে, এমনকি নিজের চোখেও যেন না পড়ে; তাই সে দিনের বেলা বনবাদাড়েই বেশী থাকে। রাতে ফিরে বুড়ি মা যদি কিছু একটা খেতে দেয় তো খেয়ে গুটি মেরে পড়ে থাকে দাওয়ায়। ভেতরে মা মায়াকে জড়িয়ে ধরে সাহস দেয় বেঁচে থাকার। গল্প বলে কিভাবে নারী তার জীবনের গ্লানি ও লজ্জাকে বিসর্জন দিয়ে বেঁচে থাকে স্বামীপুত্রের সেবা করার জন্য। দেবতা যে নারীকে পাঠিয়েছে তুষ্ট করতে পুরুষকে। পুরুষ নিজেও দেবতার সমান। তারে ঘৃণা করতে নাই। দেখিস মা, দেবতার উছিলায় ধনেজনে পূর্ণ হবে তোর ঘর। মা গো, কান্দিস না। ভাগ্য মাইনা ল।
সুখন্তের খুব ইচ্ছা করতো মায়াকে একবার জড়িয়ে ধরে কেঁদে ভাসিয়ে দিক ওর সকল দুঃখ। একবার ওর কাছে ক্ষমা চেয়ে নিক নিজের কাপুরুষতার। একবার স্বীকার করুক, এই নিষ্ঠুরতার দায় পুরোটাই সুখন্তের। কিন্তু সুখন্ত কিছুতেই পার হইতে পারে না এককোনা ভেঙ্গে নুয়ে পড়া চাটাইয়ের দুয়ার, কিছুতেই উঠে আসতে পারে না দাওয়া থেকে মাঝঘরে মায়ার বিছানায়। কত রাত জেগে কাটিয়েছে, কত শত বার উঠে বসেছে, পা বাড়িয়েছে দুয়ারে; কিন্তু কী এক অমোঘ অদৃশ্য সুতার জাল বরাবরই সুখন্তের পা জড়িয়ে ধরেছে শক্ত করে।
দিন গেল, মাস গেল, বছরও গেল। মায়ার কোল জুড়ে আসলো এক অপূর্ব ছেলে-সন্তান। প্রথম যেদিন মা এসে বললো মায়ার পোয়াতি হওয়ার কথা সুখন্ত কেমন যেন কেঁপে উঠেছিল। হায় ভগবান, আর কত! বুড়ি মা কাছেই বসা ছিল। পুত্রকে জড়িয়ে ধরে দৃঢ়কণ্ঠে বললো, ‘ভগবান যা দেয় তাই লইতে হয় সুখ। মানুষের কী ক্ষমতা আছে তার ইচ্ছার বেঘাত ঘটায়। আমি বুঝি তোর দুঃখ বাজান। মায়াডার দুঃখও তো তোর বুঝতে অইবো। তুই যদি এমন করছ তাইলে মায়াডা বাঁচবো না। বাজান আমার, বুড়া হইছি। এই জীবনে কত কিছু দেখলাম! মানুষ্যজীবন পাপের ভাগাড়! পাপ ছাড়া জীবন হয় না বাজান। সবাই এই আগুনের মধ্যে দিয়াই যায়তাছে। তুই একলা না। মন খারাপ করিস না বাজান। আশেপাশের সবাই চিলের চোখ নিয়া তাকায়ে আছে। মায়ারেও কইছি। মানইজ্জত ঢাইকা রাখলেই থাকে। তোর বুঝতে হইবো বাজান। আমি যাই, মাইয়াডারে দেখি।’
অসীম অন্ধকার ভেদ করে সত্যি-সত্যি একদিন চাঁদের মতো এক ছেলে সুখন্তের ঘরে আসলো। আলো করলো পাড়ার সকল কিছু, শুধু অন্ধকার করে রাখলো সুখন্তের আঙ্গিনা। সুখন্ত একবার ছেলেকে দেখে, একবার দেখে আজব নীল দরিয়া। একবার দেখে নিজের সন্তান, একবার দেখে অবিচারের খড়গ হাসে দাঁত কেলিয়ে। তারপরও সুখন্ত মেনেই নেয়, নিতে হয়। কিন্তু মায়ারানী - সে মেনে নিতে পারেনি। কতবার ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে মাকে বলেছে একটু বিষ এনে দিতে, কতবার বলেছে হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে বাচ্চাটা নষ্ট করে দিতে। কিন্তু সুখন্ত তা পারেনি। মাকে না জানিয়ে সে একদিন বংশী কবিরাজের বাড়ি যায়। কিন্তু বংশীকে ঠিকভাবে বলতে পারেনি লজ্জায়। মার কাছে শুনেছে মায়া প্রায়ই পেটে বাড়ি দিয়েছে হাতুরি দিয়ে, ব্যথায় নিজেই কুঁকড়ে উঠেছে। কিন্তু ভগবানের কৃপায় এই জারজের কিছু হয় নাই। সে সমস্ত কিছুকে পার করে আসলোও দুনিয়াতে। কিন্তু মায়ার চেষ্টা থামে নাই। আঁতুড় ঘরেও আবুদ্দের মুখে লবণ ঠেসে দিয়েছিল। মরেনি! সব চেষ্টা ব্যর্থ হলে একদিন ঘুম থেকে উঠে দেখা গেল মায়ারানী ঘরে নাই। তারপর সারারাজ্য খুঁজেও তার কোনো হদিস করা গেল না। মায়ার নিখোঁজ হওয়ার কয়েকদিন পর ছেলেটা যখন না খেয়ে প্রায় মরমর অবস্থা তখন একদিন মতি চেয়ারম্যান এসে হাজির, হাতে একখান গুঁড়া দুধের টিন। বুড়ি যেন অসীম সমুদ্রে একখান কাঠ খুঁজে পেল শিশুটিকে বাঁচাবার। সুখন্তের সাহস কই যে মুখের উপর না করবে। এই খত্যানে মতি চেয়ারম্যানের মুখের উপর কথা বলার সাহস সুখা কেন, সুখার বাপদাদা চৌদ্দ পুরুষের কারও ছিলও না, এখনও নাই। তারপর যতি চেয়ারম্যান প্রায়ই আসে। ছেলের দুধ-মেসরির আর কোন অভাব হয় নাই কোনদিন। বুড়িকেও মতি চেয়ারম্যান চকিদার দিয়ে রেশনের চাল-ডাল-নুন-তেল পাঠিয়ে দিতো। কাজ করুক আর না করুক থালায় ভাতের অভাব হয় না সুখন্তের। চেয়ারম্যান নিজ থেকে সুখন্তকে একদিন ডেকে নিয়ে নিজের ইজারা নদীর দেখভালের দায়িত্ব দেয়। নদীতে কখন কে খেউ কাটবে, কে ঝাটি ফেলবে, কার কতটুকু হিস্যা, গুঁড়া মাছের চালানটা কার নৌকায় যাবে, নদীর বাঁকের শেষমাথায় কে দিবে পাটিবান তার অনেককিছুই এখন সুখন্তের হাতে। ক্ষমতার স্বাদ কখন যেন সুখন্তের সব দুঃখ শুষে নিলো। কাইমের বাউলী গ্রাম দেখভালের ভার এখন সুখন্তের। চেয়ারম্যানের ঘনিষ্ঠ লোক বলে গ্রামবাসী কখন যেন সুখন্তকে মুরব্বী মানা শুরু করলো। সুখন্ত এখন পাড়ার আচার-বিচারের মালিক। চেয়ারম্যানকেও কিছু বলতে হলে সুখন্তের মাধ্যমেই যেতে হয়। চেয়ারম্যান কখনও যদি কাইমের বাউলী গ্রামে আসে তো সুখন্তের দাওয়ায়-ই একটু বসে। ছেলেটার খোঁজখবর নেয়। সুখন্ত আবারও নদীতে যায়। এই গত কয়েক বছর ধরে নদীর ইজারা যে-ই পাক সুখন্তের ভাগ নিশ্চিত। জাল ফেলে তুলে আনে কাঁড়ি কাঁড়ি মাছ। ডুবে থাকে মাছ আর পানির খেলায়। ছেলেটাও আস্তে আস্তে বড় হয়ে কখন যেন সুখন্তের সুখসাগরে পরিণত হয়েছে। সতিশকে না দেখলে মন কেমন হাহুতাশ করে। মাছে মাঝে মনে হয় ছেলেটা কার? আমার, না মতি চেয়ারম্যানের? সুখন্তের এই হিসাবটা বেশীদূর আগায় না। মনে হয় ছেলেটা আসলে মায়ারানীর। দেখতেও কিন্তু মায়ার মতোই। মায়া চলে গেছে কিন্তু ছেলেটার জন্যে হলেও কেন যেন মনে হয়, মায়া চলে যায়নি। আছে, আশেপাশেই হয়তো আছে কোনো একদিন চলে আসবে। হয়তো আমাদের জীবনে কিছুই ঘটেনি। হয়তো পুরো ব্যাপারটা একটা খারাপ খোয়াব। হয়তো সকাল হলে সব ঠিক হয়ে যাবে।
সুখন্ত কান পেতে রাখে পাখির ডাক শুনবে বলে, মোরগের বাক শুনবে বলে; কিন্তু সারা পাড়ায় একটাও মোরগ নাই, পাখির কিচিরমিচির নাই। শুধু চারপাশের গ্রাম থেকে একসাথে আট-দশটা মাইকের আযান ভোরের অন্ধকারকে আরো ঘনীভূত করে, আরো শঙ্কিত করে। ভোরের বাতাস কেমন ভারি ভারি লাগে। মনে হয়, অন্ধকারে এই আযানের সাথে ভেসে আসে শান্তি না, মৈত্রী না, সৌহার্দ্য না; উন্মাদনার বিষাক্ত ফোঁসফোঁসানি। ভেসে আসে রাত্রির গর্ভ থেকে জেলেনীর রক্তস্রাব। ব্যথায় কুঁকড়ে যাওয়া কোন এক অভাগিনীর অভিশাপ নিয়ে শুরু হয় মন্দিরের উলুধ্বনি। গঙ্গা মা প্রসব করে মেঘের উল্কিআঁকা সোনার সূর্য।
ঘোড়াউত্রার পাড়ে বালুর বিন্দুর মতো ক্ষুদ্র এই গ্রাম সারারাতের নির্ঘুম তন্দ্রাকে পাশ কটিয়ে একটু নিশ্চিন্ত ঘুমের আমেজের আশায় পাশ ফিরে শোয়। ঈশ্বরের দুনিয়াতে রাত্রি নামে, ঘুমপরীদের দেশ থেকে নিয়ে আসে নিদ্রাকুসুম তেলের সুবাস আর মাতৃগর্ভের নিরাপত্তা, কিন্তু কাইমের বাউলী গ্রামে এই নিরাপত্তার কোনো অনুভূতি নেই, নেই কোনো স্বস্তির আধার। এখানে রাত্রি মানেই দৈত্যদানবের ফোঁসফোঁসানি, ঈশ্বরের গর্জন, সাপের শিস, কৌড়ালের কান্না, বাজের পাখা ঝাপটানো, আর কীটপতঙ্গের কিটিরমিটির। ভোরের আলোই এখানে ঘুমের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে। সুখান্ত এই স্বস্তির পরশে ঘুমিয়ে নেয় সারাটা সকাল। আজ একটু বেশীই ঘুমায়। মনে হয় অনন্তকাল ধরে ঘুমিয়ে আছে, স্বপ্নে-দুঃস্বপ্নে পার করেছে পুরোটা জীবন। ঘুম থেকে উঠেও সুখন্তের মনে হয়নি কোনো দুশ্চিন্তার কারণ আছে। হঠাৎ করেই সতিশের কথা মনে হওয়াতে অন্তরাত্মা মোচড় দিয়ে ওঠে। ছেলেকে না দেখে সুখন্ত কাউকে কিছু না বলেই গাঙ্গের দিকে রওয়ানা দেয়। গাঙ্গের পাড়ে বাড়ি সুখাদের, উঠান থেকেই যেন নদীতে ঝাঁপ দেয়া যায়। সেই নদীতে পৌঁছাতেই ঘেমে উঠে সুখন্ত। বাপ-জনমের চেনা গাং কোনদিন এত বড় মনে হয় নাই। আজ গাঙ্গের কোনো কূলকিনারা নাই। অথৈ কালোজল সমুদ্রের রূপ নিয়া উথালপাথাল করে। ঢেউয়ের মুখ সাপের ফণা নিয়ে দৌড়ে আসে ছোবল দিতে। ঘোড়াউত্রা নদী এক নিমিষেই ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে কষ্টের নীলসাগরে। সুখন্ত কোথায় যাবে? কোন পাড়ে ভিড়াবে ডিঙ্গা? বৈঠা সে চালায় ঠিকই কিন্তু নৌকা সামনে-পেছনে কোনদিকেই না গিয়ে একই জায়গায় ঘুরপাক খায়। ঘুরতে ঘুরতে নৌকা কখন যেন মতি চেয়ারম্যানের বাড়ির ঘাটে এসে ভেড়ে। সুখন্ত বুঝে উঠতে পারে না নৌকা কেন মতি চেয়ারম্যানের বাড়ির ঘাটলায় এসে ভেড়ে। আর যা-ই হোক, সতিশের এই ঘটনাতো মতি চেয়ারম্যানকে বলা যাবে না। বললেও কী বলবে তা ভাবতে ভাবতে আশি বছরের বৃদ্ধ মতি চেয়ারম্যান নিজেই এসে ঘাটলায় দাঁড়ায়। নিজ থেকে বলে, সুখা তুই বাড়ি যা। বিষয়টা অনেকদূর গড়াইছে। যা করার আমিই করুম।
সুখন্ত চেয়ারম্যানের পা জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে ওঠে। যদিও সুখন্ত মনে মনে ঠিক করে রেখেছিল কিছুতেই সতিশের কোনো ব্যাপারে চেয়ারম্যানের সহযোগিতা নেবে না। কিন্তু চেয়ারম্যানের এই পা যেন পাণ্ডবের মসনদের চাইতেও শক্তিশালী, যার সামনে আসলে মানুষ কেন গরুছাগল-গাছপালা সবই নুয়ে পড়ে। এমন সিংহশালী লোকের সামনে দাঁড়ায়ে থাকার মতো শক্তি-সাহস কোনটায় সুখন্ত বাপজন্মে অর্জন করে নাই। তাই দেখা হওয়ার সাথে সাথে হাজার দিনের প্রতিজ্ঞা এক নিমিষে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে।
সুখন্ত খুব ভাল করেই জানে ডেঙ্গুরের হাতে থেকে সতিশকে উদ্ধার মতি চেয়ারম্যান ছাড়া আর কেউ পারবে না এই তল্লাটে। কেউ বলুক আর না বলুক, ডেঙ্গুর যে মতি চেয়ারম্যানের জারজ সন্তান তা তো আর সে গোপন রাখতে পারে নাই। এতদিন অস্বীকার করলেও গত বৈশাখের ধানকাটার সময় ডেঙ্গুর তার বাপের বাথান সাপাত চৌদন্ত দখল নেয়। সে নিজেরে ঘোষণা করে মতি চেয়ারম্যানের পুত্র হিসাবে। ঘটনার পর জানা যায়, মতি চেয়ারম্যান বাথান উদ্ধারের কোনো চেষ্টাও করে নাই। তেনার বৈধ সন্তানরা বাথান উদ্ধারের কথা বললেও চেয়ারম্যানের নীরবতায় সেই চেষ্টা খুব বেশীদূর আগায় নাই। এলাকাবাসীরা বহুদিনের জল্পনা-কল্পনার একটা বিহিত হওয়াতে চৈত্রমাসের কাঠফাটা রোদে আষাঢ়ের আমেজ নিয়ে গল্পে মেতে ওঠে। ‘এতদিন বাপ আকাম-কুকাম করছে বাতানে, এহন পোলায় কোরবো।’
মতি চেয়ারম্যানের এই বাথান তার হেরেমখানা হিসাবেই খ্যাত। বিশ মাইলের মধ্যে মানুষজনের কোনো চিহ্ন নাই, সুনামগঞ্জের এক বিরাট হাওড়; তার মাঝে সাপাত চৌদন্ত। বহুদিন পর মতি চেয়ারম্যান তার ইজ্ঞিন-নৌকা, দোনালা-বন্দুক আর সুখন্তসহ ৫ জন বছইরে-বান্ধা কামলা নিয়ে রওয়ানা করে সাপাত চৌদন্তের দিকে। সাতজন মানুষ, কারো সাথে কারো কথা নাই, চাওয়াচাওয়ি নাই। চেয়ারম্যানের চোখে-মুখে ঘনিয়ে-আসা-কালবৈশাখী সবার মুখ কালো করে একটা চরম অনিশ্চয়তাকে তিরতির করে কাছে টানে। চেয়ারম্যান যেন এক পরাজিত রাজা, যে আপন সন্তুানের কাছে রাজ্য হারিয়ে পুনরায় দাক্ষিণ্য চেয়ে মুখ পেতে আছে। নৌকা যখন শবরী কান্দার চর পার হচ্ছে তখন অজানা এক কারণে চেয়ারম্যান বলে, ‘আমাকে এই চরে নামায়ে যা। তরা যা, সতিশরে নিয়া আয়। সুখা আর ওর ছেলেরে বাড়ি পৌঁছায়ে দিয়া আসিস।’ মতি চেয়ারম্যান মাথা নীচু করে কারো দিকে না তাকিয়ে নৌকা থেকে নেমে যায় নির্জন এক বালুচরে। আর ওরা উজানি বেয়ে শেষ পর্যন্ত পৌঁছায় সাপাত চৌদন্ত।
আমরা গ্রামবাসীরা খবর পাই আজ রাতে কেউ শিকার হয়নি ডেঙ্গুরের। সে গানবাজনা নিয়ে মত্ত ছিল সারারাত। আসরের প্রধান আকর্ষণ সতিশ। গান এবং নাচে যার ঋষিরধ্যান ভঙ্গ করে, অন্তরাত্মায় জাগায় প্রকৃতির আদিমতা। ডেঙ্গুর যখন সতিশকে বাড়ি থেকে ডেকে আনে তখন সুখন্ত শেষবারের মত জ্বলেওঠার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু ডেঙ্গুর সুখন্তের হাত ধরে কথা দিয়েছে, ছেলে নিয়ে যাচ্ছে আবার নিজে এসে বাড়ি দিয়ে যাবে। ছেলের কোনো অনিষ্ট সে করবে না। সতিশকে সে ছেলের মতোই আদর করে। শুধু গান-বাজনাই তার উদ্দেশ্য, আর কিছু না।
ডেঙ্গুর তার কথা রাখেনি। সুখন্ত ছেলেকে সকালবেলায় মতি চেয়ারম্যানের বাথান থেকে উদ্ধার করে। ছেলেকে নিয়ে নৌকায় ওঠার সময় সুখন্তের সারা শরীর কাঁটা দিয়ে ওঠে, মনে হয় মায়া তার দিকে তাকিয়ে আছে। দেউড়ির ফাঁকে দাঁড়িয়ে-থাকা মহিলাকে কেন তার মায়া মনে হলো এর কোনো রহস্য উদ্ধারের কায়দা তার জানা নাই। মায়া কি তাহলে চেয়ারম্যানের হেরেমে এসে উঠেছিল? মায়া কী এখন ডেঙ্গুরের দখলে? এই চিন্তা মাথায় নিয়েই সুখন্ত ছেলে নিয়ে দিলালপুরে সুনীল ডাক্তারের বাড়ির দিকে রওয়ানা করে। ছেলে যে ব্যথায় কোঁকড়াচ্ছে! সুনীল ডাক্তার ব্যথার বড়ি দেয়, মূল্যবান পরামর্শ দেয়; বলে, বাড়ি নিয়ে ছেলেকে রেস্টে রাখো। দুই-একদিনে ঠিক হয়ে যাবে। চিন্তার কিছু নাই।
‘চিন্তার কিছু নাই’ এই বোধ সুখন্তের মগজের কোষে কোষে তৈরী করে বরফের ইট-সুরকি, আসমানের সমান নীরবতা। ঈশান কোনায় ভয়ানক কৃষ্ণকালো মেঘ সাথে আগুনের উল্কি-আঁকা বিজলী মাথায় নিয়া সুখা মাঝির ভাঙ্গা নৌকা তখনও দুলতে দুলতে এগিয়ে চলে আরো একটি ভয়াল বর্ষাকে আলিঙ্গন করার অভিপ্রায়ে।