জাগরণের ডোজ
সমুদ্র উত্তাল। পানির বদলে মানুষের নোনতা ঘাম আর ভোটকা গন্ধের ঢেউ সবকিছু ছাপিয়ে এসে বাদলের গায়ে আছড়ে পড়ে। চোখে-মুখে এসে ছিটকে পড়ে নানারঙের রক্তের ছিটা। নাকি চোখ থেকেই নানাবর্ণের রক্তছটা টিকরে বেরোয় বাদলের এতকিছু ঠিক-ঠিক ঠাহর করা হয়ে উঠার আগেই প্রচণ্ড একটা ঢেউ এসে আছড়ে পড়ে ধাক্কা খায় শানবাঁধানো ঘাটে। ঢেউ আর শানবাঁধানো ঘাটের বাড়িতে মাথা ফেটে চৌচির। ঢেউয়ের পর ঢেউ আসে দম ফেলার সুযোগ নাই, কান্নাতো দূরের কথা! সেবার বাদলের নানাজান বাজের মতো থাবা দিয়া উঠায়ে নিছিলো বাদলকে। এইবার এই আগুনের স্রোতে সবকিছু ভাইসা যায়। কিছুই থামার লক্ষণ নাই। আগুনের এই ঢেউ একবাড়িতে বাদলকে শাহবাগ থেকে নিয়ে যায় সানকির চরের শানবাঁধানো ঘাটে, আর-এক বাড়িতে নিয়ে আসে বাংলামটর, শেরাটনের মোড় হয়ে শাহবাগে। এত মানুষ, মানুষের সায়র! তাও কেউ কারো দিকে চোখ তুলে তাকায় না। বাদল যে রক্তের স্রোতে ভাইসা যাইতেছে তা কি কারো নজরেই পড়ে না। লক্ষনিযুত মানুষের মাঝে বাদল প্রিয় নানাজানের মুখ খোঁজে। বাদলের মনেহয় নানাজান নিশ্চয় বাজের মতো আইসা থাবা দিয়া উঠায়ে নিবো। তিনিতো বিরাট পাওয়ারী লোক, ডাকসাইটে মুক্তিযোদ্ধা, এলাকায় চেনে না এমন লোক নাই। ওসিসাহেব দেখলে মোটরসাইকেল থামায়ে সালাম দেয়। বাদলের নানাবাড়িতে ছিল শানবাঁধানো ঘাট। ভরাবর্ষায় দুনিয়া যখন সায়রে পরিণত হয়; সানকির চর, নামাহাটি, কুড়াল্লে, কাপড়তোলা গ্রাম যখন ঢেউয়ের নীচে হারায়ে যায়, তখনও বাদলের নানাবাড়ির সেই শানবাঁধানো ঘাট প্রবল বিক্রমে যুদ্ধ করে যায় ঢেউয়ের সাথে। ঢেউয়ের কি সাধ্য আছে ওর বালটা ছিঁড়ার! সরকারী খরচে কেনা ওয়াপদার ইট, সিলেটি বালু আর ইন্দো সিমেন্টের গাঁথুনি ভেদ করা কি আর বইহার বন্দের ঢেউয়ের পক্ষে সম্ভব? বাদলের নানার হাতেগড়া শানবাঁধানো ঘাট কি আর হাল-আমলের দুইনাম্বারি ঢেউয়ে ভাঙ্গে? সে সায়রের ঢেউ হোক আর হাওরের ঢেউ হোক। না, ভাঙ্গে না।
ঝনঝন কইরা কী যেন ভিতরে ভিতরে গুঁড়া হইতে থাকে। ডাণ্ডাবেড়ি, বুটের আওয়াজ আর জল্লাদের গলার স্বরের মতো ঢেউ আসে মানুষের মিছিল থেইকা। মানুষের স্রোতে তাল সামলাইতে পারে না চল্লিশোর্ধ্ব ডায়াবেটিস-আক্রান্ত বয়সের তুলনায় দ্বিগুণ বুড়িয়ে যাওয়া বাদলের শরীর। দারোগার বুটের আওয়াজ শুইনা শরীরের সব ভয় নয়-দরজার কোনটা দিয়ে যে বাইর হবে তা ঠিক করতে না পাইরা বুকের ভিতর আউলা-জাউলা দৌড়াদৌড়ি করে। তার ঝাপটায় কান দিয়া ধোঁয়া, চোখ দিয়া নাক দিয়ে নোনাজল, মুখ দিয়া তরল লালামিশ্রিত গোঙ্গানি বাইর হয়ে পাঁচফুট বাই পাঁচফুট এই লোহার কামরায় ঘুরপাক খায়। বাইর হওয়ার কোনো পথ আবিষ্কার করতে না পাইরা নিজের কানেই ফেরত আসে, ঢুকতে গিয়া আবারও যুদ্ধ করে ধোঁয়ার সাথে। হালার দুনিয়ায় ধাক্কাধাক্কি ছাড়া কোনো কাজ করা যায় না! গোঙ্গানির কী সাধ্য যে গণ্ডারের চামড়া ভেদ করে শুয়োরের মনে পৌঁছায়।
শালা শিবিরের গাগু মাল স্যার! আমারে বোঝায় শিবির নাকি কমুনিস্ট! পেদানির চোটে আবোলতাবোল যা খুশি তাই কয়।
বাদল ঘাড় তোলার চেষ্টা করে। চোখ খুলে দেখে স্যাঁতস্যেতে মেঝে। রক্ত আর রক্তমেশানো পানি নাকি মুত তার চোখের খুব কাছাকাছি থেকে পাশের রুমের আলোটা নিজের গায়ে মেখে সামান্য ঝিলিক দেওয়ার চেষ্টায় ব্যাপৃত। ঘাড়টা আর কিছুতেই ঘুরানো যাচ্ছে না। শালা ঘাড়টা কি ভাঙ্গেই গেল! হাত দুইটা কি দারোগার বাচ্চা রানের চিপায় গ্লু দিয়া লাগায়ে দিছে! হাত যে আছে বুঝা যায় কিন্ত কোনো কাজে লাগানো যাচ্ছে না। টান দিয়া যে বাইর কইরা আনবে তা মাথার মধ্যে মস্তিষ্কের কোষে কোষে অনুরণন তুললেও সিগনাল হাত পর্যন্ত পৌঁছাতে পার করে দিচ্ছে কয়েক যুগ।
কি, ডোজ কি বেশী দিয়া দিছেন?
স্যার একটু-আধটু দিছি। কিন্তু গাগু মাল! একবার কয় শিবির করে, একবার কয় আওযামী লীগ করে। একবার কয় ওয়ার্ড কমিশনার ওরে চিনে। অবোলতাবোল স্যার!
বাদলের খুব ইচ্ছা করে ঘাড় তুলে বলতে, কুত্তার বাচ্চা, আমি শিবির করি না! এক সময় লেখক শিবির করতাম। শিবির আর লেখক শিবির এক না। মূর্খের বাচ্চা! কিন্তু কথাগুলো মুখের মধ্যে তালাবন্ধ অবস্থায় থাকায় আর বাইর হইতে পারে না। বরং ভাবে, কেন যে আমি লেখক শিবিরের নাম কইতে গেছিলাম! এহন তো হালা আমারে শিবির কইয়া মাইরাই ফালাইবো! হায়, নিউটন ভাই যদি জানতো! সোনমের মা-বোন গিয়া নিউটন ভাইরে ক। উনি খবর পাইলে ষাঁড়ের মতো ছুইটা আসবো। আরে উনার জন্যে কম করলাম! গত ইলেকশনে একমাস কাজই করলাম না। সারাদিন মিরপুরের অলিতে-গলিতে ক্যাম্পিং কইরা বেড়াইছি। পার্টির জন্যে এতকিছু করছি, আর পার্টি কি আমার জন্যে কিচ্ছু করবো না! এহন আমরা ক্ষমতায়, আমার নেত্রী এখন দেশনেত্রী। বোন তুই খালি গিয়া পার্টি অফিসে খবরটা দে। দল আমার ক্ষমতায়। নেত্রীরে ধর্ম-মা জানি মনে মনে। নিউটন ভাইরে কইছি, একবার, শুধু একবার নেত্রীর পা ছুঁয়ে সালাম করতে চাই। উনিও কথা দিছে, নিয়া যাইবো একদিন গণভবনে। উনি আমার জন্যে সবই কোরবো। মাগি তোর কি ঘুম ভাঙ্গে না! আর কত ঘুমাইবি! যা এইবার গিয়া নিউটন ভাইরে খবরটা দে। শালা কুত্তার জাত আমার পিছু নিছে! খাড়া দেখাইতাছি কত ধানে কত চাল! আওয়ামী লীগের কর্মীর গায়ে হাত! যা, এত ঘুমাইস না! কামকাজ কইরা খাওন লাগবো না? তোর পোলার কারণেই তো এই দশা! এই মা আর পোলার যন্ত্রণায় আমার রাজনীতি-ফাজনীতি সব চুলায় গেল! হালার ভাবছিলাম দেশের জন্যে একটা কিছু করুম। লেখক শিবির থেইকা শিক্ষা নিছিলাম। কাইয়ূম ভাইদেরও তো পায়ের নীচে মাটি নাই। সবাই যার যার ধান্ধায় নানা কাজে লাইগা গেছে। আমি কী করুম! আওয়ামী লীগতো আর এমনি এমনি করি নাই। পাওয়ার পার্টি না করলে সমাজে কোনো দাম আছে নাকি? পার্টি না করলে রাস্তার নেড়ি কুত্তাও হালার ধমক শোনে না। ধমক দিলে লেজ খাড়া কইরা কয়, চুদলাম না! কিন্তু কেন যে আমি মাঙ্গির পুলা টোলার বাচ্চারে লেখক শিবিরের কথা কইতে গেছিলাম! সোনমের মা, বোন কাইয়ূম ভাইয়ের কাছে যা। উনি এখন বিরাট উকিল! আমি আওয়ামী লীগ করি আর যুবলীগ করি, উনি আমার বিপদের কথা শুনলে দৌড়ায়ে আইবো। আওয়ামী লীগতো বড় দল পাত্তা কম। লেখক শিবির ছোট, একজন কর্মীর জন্যে সবাই জান দিয়া ঝাঁপায়ে পড়ে। যা বোন, কাইয়ূম ভাইয়ের কাছে যা।
কেন যে তোর পোলার দুধ কিনতে গেছিলাম! নাইলে পুলিশের বাপের সাধ্য আছিলো আমার গায়ে হাত দেয়। আহারে আমার আব্বা, বাবা সোনম, এইতো বাবা তোমার জন্যে দুধ আনতে গেলাম। যামু আর আমু। দুর বাল, নিউটন ভাইয়ের কথাটা শুনা ঠিক হয় নাই! পোলার দুধটা কিইনা দিয়া গেলেই এই প্যাচ লাগে না।
এইতো গত সন্ধ্যার কথা। নিউটন ভাইয়ের মিছিল নিয়ে শাহবাগে গেছিলো বাদল। সোনমের মা পাঁচশো টাকার নোট হাতে ধরায়ে দিয়া কইলো সোনমের দুধটা আইনা দিয়া যাও। ঘরে কিন্তু আর এক বোতল দুধও নাই। তুমি আইবা সেই কোন রাইতে কে জানে। যা-ই করো, দুধ দিয়া করো। দুধ না দিয়া গেলে কিন্তু গান্ধীগিরি ছুটায়ে ফালামু।
আরে এত ফেডর-ফেডর করিস না! কইলাম তো, আসার সময় দুধ নিয়া আসুম। শাহবাগে কত দোকান আছে না। বাদলের দুধ কেনার সময় কই। নিউটন ভাইয়ের মতো লোকরে খাড়া করাইয়া রাখা যায় নাকি! তাইতো দুধ কেনার কথা মনে হইলো যখন তখন বাসায়। সোনমের মা কয় দুধ কই? রাত তখন ১১ টার কাঁটা পার হইয়া গেছে। তাতে কি, প্রিন্স বেকারী তো মোটামুটি রাত ১১-১২টা পর্যন্ত খোলা থাকে। সরি সরি বইন। এই এক্ষণ যাইতেছি দুধ আনতে। সোনম এরিমধ্যে ঘুম থেকে উঠে চোখ না খুলেই শ্লোগান ধরে, রাজাকারের ঠাঁই নাই মুজিবের বাংলায়। ইয়েস বাবা, এইবার রাজাকারদের পাকিস্থান না পাঠায়ে ছাড়তেছিনা। বাদল বেডরুমে ঢুকতে যায় ছেলেটাকে একটা চুমু খাবে বলে। সোনমের মার ভেঙচি শুনে পা আর বেডরুমের দিকে না গিয়ে দৌড় লাগায় প্রিন্স বেকারীর দিকে।
স্যার, আসেন স্যার।
স্যার, ধরছি তো মিরপুর ১১ থেইকা। প্রিন্স বেকারীতে চুরির ধান্ধায় উঁকিঝুকি মারতেছিল। স্যার, রুহুল আমিন ধরছে। রুহুল আমিনরে তো শালা কলার চাইপা ধরছিল! আবার কয়, রুহুল আমিন নাকি ওর বাচ্চার দুধের টাকা কাইড়া নিছে! শালা ডেনজেরাস স্যার, আসল শিবির।
বাদলের পেটের ভিতর রাজ্যের কথা গুরগুর করে। ওসি সাহেবরে সব কথা খুইলা কইলে উনি হয়তো বুঝতো। শালা শুয়োরের বাচ্চারাতো আমার বাবুর দুধের টাকার লোভে আমারে মাইরা ফালানোর ধান্ধা করছে!
বুটের আওয়াজ এত কাছে চলে আসে যে বাদলের আর উপায় থাকে না। ঘাড় তুলে দেখে দুইজন তালগাছ ওর মাথার কাছে দাঁড়ায়ে আছে। বাদল এই দুই তালগাছের মাথার বদলে আসমানের মতো পলেস্তরা খসে-পড়া ছাদ দেখে। একটা কৌড়ালের কান্না গলার কাছে আইসা আইটকা থাকে, বাইর হয়না। এই বালের কান্নাটা পেটের ভিতর গুরগুর করা কথাগুলারেও আটকাইয়া রাখছে। বাদল কিছু বলার আগে তালগাছের একজন কয় - দিছেন তো মাগার বারোটা বাজায়ে! হাসপাতালে পাঠান।
স্যার, আমি দেই নাই। রুহুল আমিন দিছে। শালা শিবিরের বাচ্চাতো, রুহুল আমিনরে চোর কয়ে গালি দিছে! কয়, এই শালা ডাকাতের বাচ্চা, আমার বাবুর দুধের টাকা কাইড়া নিছে! স্যার, এই টাকার জন্যেই ধাস্তাধস্তি! পরে-না আমরা গিয়ে ধরি। রুহুল আমিন কয়, শালা নাকি প্রিন্সের দরজা ভাঙ্গার চেষ্টা করছিল! ধরাপড়ার পর কয়, বাচ্চার দুধ কিনতে আইছে।
টাকা কই?
টাকা স্যার রুহুল আমিনের কাছেই।
পাশের জন খেঁচখেচিয়ে ওঠে, এই তুই কী জানচ?
স্যার, রুহুল আমিন কয়, কোনো টাকা সে নেয় নাই।
তারপর যখন পিকআপে উঠায়ে ধোলায় কিছু দিলাম তখন কয়, আওয়ামী লীগ করে; তারপর কয় লেখক শিবির করে। একবার কয় গণজাগরণ মঞ্চ থেইকা আইছে। তয় শিবির করে বলার সাথে সাথে আমরা বুইঝা ফালাই শালা গাগু মাল। তারপর আর ছাড়ি না। থানায় নিয়া আসি। ইন্টারোগেশনের সময় আমাদের যে কতরকম থ্্েরট করছে যদি শুনতেন! কয় ১১র কমিশনার নাকি ওরে চেনে! দিলাম রাতে ফোন। উনি ফোন ধইরাই ধমক। এত রাতে ফোন! কইলাম যে আপনার কর্মী ধরা পড়ছে চিনেন কিনা। কইত্থেকে স্যার উনি তো চিনলো না। কইলাম শিবির যে করে। শুনে কইলো দেন ধোলায় ঠিকমত, সব কথা বাইর করেন। সকালে আমারে জানায়েন কি হইলো।
স্যার লেখক শিবির, শিবির না স্যার। আমার নেতা হাসান কাইয়ূমরে জিগান স্যার। আমি এন্টি-শিবির স্যার।
হ এহন তুই কত কথাই কইবি।
বাদল নিভে যাওয়া বাত্তির শেষবার মতো জ্বলে ওঠার মতো কথাগুলো বলেই একবারে চুপ মেরে যায়।।
এই হালায় মরছে নি! তাড়াতাড়ি হাসপাতালে পাঠান। শিবির হোক আর বিপ্লবী হোক, আমার থানায় যেন না মরে। সেখানে গিয়া গোয়া মারানি খাক! শোনেন, সাথে স্টেটমেন্ট দিয়া দেন। মিরপুর ১১ থেকে গণপিটুনির হাত থেকে পুলিশ কর্তৃক শিবির-কর্মী উদ্ধার করে হাসপাতালে প্রেরণ করা হয়। নাম-ঠিকানা যদি কিছু পাইয়া থাকেন দিয়া দেন। যান তাড়াতাড়ি করেন। ওর অবস্থা বেশী সুবিধার মনে হচ্ছে না। শিবির-কর্মী হইলে কোন অসুবিধা নাই। বাট যদি আবার সত্যি-সত্যি আওয়ামী লীগ করে তাইলে কিন্তু ঝামেলা হয়ে যাবে। যান, তাড়াতাড়ি হাসপাতালে টান্সপার করেন। আপনারা আর কোত্থেকে শুনবেন লেখক শিবিরের কথা। আমি কিছু কিছু জানি। ছাত্রজীবনে আমার কিছু বন্ধুবান্ধব ছিল যারা লেখক শিবির করতো। আমরা তাদের শিবিরই বলতাম। কিন্তু আসলে ওরা ছিল কমুনিস্ট। সাংঘাতিকভাবে এন্টি-শিবির। আমাদের কিশোরগঞ্জ এলাকায় কিছু ছিল। তার কিছু কিছু জানতাম। তারপরতো চান্স পেলাম সিলেটে, সেখানে আর কোনো পলিটিক্স-মলিটিক্সে জড়াই নাই। রুমমেট ছিল ছাত্রলীগের, সেই সুবাদে মাঝে-মধ্যে ছাত্রলীগের মিটিংমিছিলে যাওয়া লাগতো। আর চাকরীর সময় অনেকে পার্টির তদবিরে চাকরী পাইলেও আমি কিন্তু আমার মেরিট অনুযায়ী চাকরী পাইছি। যাউগগা, যান, এখন যা বলছি তা করেন।
বাদলের কান দুইটা অকারণেই খাঁড়া হয়ে নড়েচড়ে ওঠে। মাথা তুলে শুনতে চায় সেই দূর গ্রামের ডাক। কে ডাকে বাদলকে! নেকবর নাকি? নেকবর বাদলের খালাতো ভাই। দুই ভায়ের কী খাতির ছিল! কেউ কাউরে ছাইরে যাইতো না কোথাও। সেই নেকরব কোত্থেকে আসে মিরপুর থানার কাছে! কানটা আরো খাঁড়া করে মনোযোগ দিতেই বাদল বুঝে যায় এটা নেকবরের ডাক না, সোনমের শ্লোগান। বাদলের মুখে এক টুকরা হাসি আর সোনমের শ্লোগান একই সাথে উদ্ভাসিত হয়। বাদল কান খাঁড়া কইরা শোনে ছেলেটার শ্লোগান - মুজিবের বাংলায় রাজাকারের ঠাঁই নাই, রাজাকারের ঠাঁই নাই মুজিবের বাংলায়। বাদলের খুব ইচ্ছা করে ছেলের সাথে নিজেও শ্লোগানটা ধরতে। শ্লোগানটা থানার দিকেই আসছে। নিশ্চয় সোনমের মা সোনমরে নিয়া থানায় আইতাছে। নিউটন ভাই কি আইছে? কাইয়ূম ভাই কি খবরটা পাইলো? সামান্য একটু চিন্তায় ছেদ পড়ার সাথে সাথে শ্লোগানটা দূরে চলে যেতে শুরু করে। হায় হায়, সোনম কি থানার পাশ দিয়া চলে যাচ্ছে! ওরা কি জানে না যে আমি এখানে! বাদল শেষবারের মতো মাথা তুলে চিৎকার করে ডাকার চেষ্টা করে। সোনম, বাবা, আমি এখানে! বাদলের এই চিৎকার দেওয়া ডাক পেট থেকে বাইর হওয়ার সময় করতে পারে না। চিৎকারটা গিলে ফেলে বাদলের মাথাটা রক্ত আর মুতেভেজা স্যাঁতস্যাতে মেঝেতে লুটিয়ে পড়ে।
স্যার, হালায় তো ঘাড় ছাইড়া দিছে! আপনি একটু দেখবেন?
কছ কি নাটকির পুলা! তাড়াতাড়ি হাসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থা কর।
হাসপাতালে পৌঁছানোর সাথে সাথে কর্তব্যরত ডাক্তার বাদলকে মৃত ঘোষণা করে এবং মর্গে পাঠানোর পরামর্শ দেয়। আত্মীয়স্বজন কে আছে খবর নিতে বলে। এই খবর থানায় আসার সাথে সাথে ওসি সাহেব স্থানীয় সাংবাদিকদের নিয়ে আমাদের সময়ের শ্রেষ্ট ছোটগল্প লিখতে বসেন। জোগাড় করা হয় মোবাইলে তোলা গণপিটুনির ছবি। ছবিতে দেখা যাচ্ছে ১০/১২ জন মানুষের একটা দল গোল হয়ে কাউকে বা কিছু একটাকে পিটাচ্ছে। একেক জনের মারমুখী ভাব অন্তত তাই বলে। সাংবাদিকদের সাথে বসে ওসিসাহেব দেশের অতিপরিচিত হাজার রাতের গল্পের মতোই বলে যায় বাদলের গল্প।
গতরাতে মিরপুর ১১ বাসস্টেন্ডের কাছে জনতা শিবির-কর্মী হিসাবে বাদলের উপর চড়াও হয়। জনতার আক্রমণ থেকে উদ্ধার করে সেখানে উপস্থিত কর্তব্যরত কয়েকজন পুলিশ, যার নেতৃত্বে ছিলেন এসআই রুহুল আমিন। উদ্ধারের পর পুলিশ তার নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে তাকে থানায় নিয়ে আসে। শেষ রাতের দিকে বাদলের অবস্থা কিছুটা খারাপের দিকে গেলে তাকে দ্রুত হাসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়। সেখানে কর্তব্যরত ডাক্তার তাকে মৃত ঘোষণা করে। মৃত্যুর পূর্বে বাদল নিজেকে একজন ত্যাগী শিবির-কর্মী হিসাবে পরিচয় দেন।
গল্পটার মধ্যে একটা ফোন বিনা অনুমতিতেই ঢুকে পড়ে। জানান দেয় উনি মিরপুর ১১-র ওয়ার্ড কমিশনার নিউটন। এমন লোকের ফোন রেখে কি আর গল্পলেখার কোন সুযোগ আছে!
- জ্বী, আপনাদের দোয়া।
- ভিকটিম নিজে স্টেটমেন্ট দিছে সে শিবির-কর্মী ছিল। এখন আপনি বলছেন সে আওয়ামী লীগ!
- কিন্তু ভাই কোনটা বিশ্বাস করবো! দেশে যে কে কী করে তাতো বোঝা আমার মতো অফিসারের সাধ্যের বাইরে! এই যে আপনি বলছেন, ও আওয়ামী লীগ কর্মী, আবার ও নিজে বলেছে শিবির। আমার কনস্টেবলরা বলেছে লোকজন তাকে শিবির-কর্মী হিসাবেই মারদোর করতে ছিল। কী কব ভাই! গতরাতে ঢাকা শহরের নানা জায়গায় শিবির-কর্মীরা নানা নাশকতায় অংশ নিছে। জনতাও তাদের ধাওয়া পাল্টা-ধাওয়া করছে। এখন কী কব বলেন! দেশে তো যুদ্ধ পরিস্থিতি চলতেছে, এর মধ্যে কোনকিছু সঠিকভাবে আইডেন্টিফাই করা কি চাট্টিখানি কথা? কন!
- যাইহোক, লাশ মর্গে আছে। দেখেন কী রিপোর্ট আসে। পারলে একটা উপকার করেন, ওর আত্মীয়-স্বজনদের একটা খবর দেন। বলেন আমার থানায় আসতে। আমি আমার সাধ্যমত সাহায্য-সহযোগিতা করবো। দোষীদের খুঁজে বার করার ব্যবস্থা করবো। থানার ওসি হিসাবে এইটাইতো আমার কাজ, নাকি কন। তার বেশী আর কী করতে পারি বলেন। বাকী তো সবই কোর্টের হাতে। আপনি চিন্তা করবেন না। যদি আওয়ামী লীগ কর্মীকে ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে শিবির-কর্মী হিসাবে হত্যা করে তবে এক বাঞ্চোতেরও শিরদাঁড়া সোজা রাখবো না। এইটুকুই শুধু বললাম আপনাকে। আপনি আমারে দুইটা দিন সময় দেন।
- আরে না না, আমি নিজে ছাত্রলীগের কর্মী ছিলাম না! পার্টির ছেলে নিজের চোখে মরতে দেখছি। কোনো শালার রক্ষা আছে মনে করেন?
- এইমাত্র শুনলাম যে সে মিরপুর ১১ নাম্বার ওয়ার্ডের যুবলীগ-কর্মী ছিল। এতক্ষণ পর্যন্ত তো জানতাম সে শিবির-কর্মী। তয় আপনে যখন খবরটা ঠিকসময় দিছেন, বাকী দায়িত্ব আমার। মামলা তো এহনও সাজাই নাই। এখন বলেন আপনার জন্যে কী করতে পারি। একবার আসেন, বাদাম চানাচুরের দাওয়াত রইলো। আসেন, আরে আসেন, নেতা-দর্শনে ছোয়াব আছে, আসেন।
- জ্বী, হো হো হো!
ফোন রেখে সে আবার গল্পে ফেরত আসে। এই দেখলেন তো, সারারাত ধইরা জানি যে পোলা শিবির-কর্মী, এখন কয় সে আওয়ামী লীগ করতো! বুঝেন আমাদের নেতাদের অবস্থা! রাতে কিন্তু উনারে রুহুল সাব ফোনও করছে। তখন কিন্তু উনার কর্মী উনি চিনে নাই! এখন লাশ দরকারতো তাই চিনলো আর কি!