একটি জমজ গল্প
আমি এবং বৃক্ষ একই নদীর বাসিন্দা
অনেকদিন সূর্য দেখিনা। সূর্যটা কখন যে মাথার উপর থেকে চুপ করে নেমে হাতের কব্জিতে দখল নিয়েছে তা মনে করার দরকার কতটা আছে তা নিয়ে জল্পনা করতে করতে ভুলে যায়, ভাবনাটা কী ছিল। আসলে আমি কি কোনকিছু নিয়ে ভাবছিলাম? ভাবনাগুলো কেমন যেন তরলই থেকে যায়, জেলিফিসের মতো, বিষাক্ত বর্ণহীন গোলগাল নাদুসনুদুস চলমান সচল বনসাই বটবৃক্ষ। আমার ভাবনাজুড়ে সূর্যটা ঘুরতে থাকে দিনরাত্রির কাঁটা হয়ে টিকটিক। যাব, সূর্যটা একবার ঘুরে দেখে আসবো। খুব তো বেশীদূর যেতে হবে না। শহর আর কত বড়, ১০০০০ কিলো কি তারও একটু বেশী। হয়তোবা যেতে যেতে কোন এক দালানের ফাঁকে লুকিয়ে থাকা বেড়ালটাকে দেখেও ফেলতে পারি। আমার আবার ফিরতে হবে তাড়াতাড়ি, সাঁতারের ক্লাস আছে। সবাইকে, এমনকি বৃক্ষকেও এখন সাঁতার শেখা লাগবে। দুনিয়া তলিয়ে যাচ্ছে খুব দ্রুত। তখন নিশ্চয় অনেক মজা হবে, আমি এবং বৃক্ষ একই নদীর বাসিন্দা, এখন যেমন আছি একই ডাঙ্গায়। কী অদ্ভূত না! কিছুতেই কেউ কাউকে ছাড়বো না, সহজীবন সহমরণ সহযোগে সহ্য করবো পানি এবং আগুনের সমান জিহ্বা! আমার শরীর থেকে কেমন যেন মাছের গন্ধ বার হয়। আচ্ছা আমি কি গভীর জলের মাছ হতে পারবো? চুনোপুঁটি খাবো না, রাঘব বোয়াল খাবো। বিশাল মুখ নিয়ে হাঁ করে বসে থাকবো ত্রিমোহনায়, অতঃপর জগতের সকল প্রাণী হবে আমার দাঁতের উপাদেয় উপাচার। নাকি আমিই চলে যাবো নীলতিমির পেটে? হাঙ্গর কি আমার সাথে পারবে? কিভাবে পারবে? ডাঙ্গায় থেকেই তো জলজ প্রাণীদের খাচ্ছি। সিফুড। নন্দিনীর খুব প্রিয়। আমারও। আর যখন জলজ প্রাণী হবো চুনোপুঁটি হবে চীনাবাদাম, হাঙ্গর হবে বড়জোর লাউ কি হাইব্রিড মূলা। তার বেশী কিছু নয়। আচ্ছা, মূলা কী তখন তলিয়ে যাওয়া শহরে পাওয়া যাবে? যেতেও পারে, ব্যবসাতো থাকবে। দুনিয়া ধ্বংস হয়ে যাবে কিন্তু ব্যবসা থাকবে। এমনকি হাশরের মাঠেও মানুষ ব্যবসা করবে। কেউ কেউ কোমল পানীয়, ছাতা কি জুতা নিয়ে বসে পড়বে নিশ্চয়। বিশ্বাস নাই, মানুষকে দিয়ে সবই সম্ভব। উঁ, খুশিতে দম আটকে যাচ্ছে, আমি এমন একটা জাতের প্রাণী যাকে দিয়ে সবই সম্ভব! আমি সূর্য পূর্ব দিকে ওঠে বলেছিলাম বলেই সে পশ্চিম দিকে ওঠার ক্ষমতা হারিয়েছিল। এখন আমি সূর্যকে ঢেকে দিচ্ছি, দুনিয়াকে অন্ধকার করে বিদ্যুতের ব্যবসা করবো। আমার কাছে ইউরেনিয়াম আছে, আণবিক শক্তি আছে। আলো বিক্রি করবো সের দরে। প্রভুত উন্নতি করে আমরা দুনিয়াসুদ্ধু পানির নিচে চলে যাবো। খুব মজা হবে, দুনিয়াটা তলিয়ে গেলে আসলেই খুব মজা হবে! আমার কেবলই মনে হয় এতো দেরি হচ্ছে কেন, সবকিছুতেই অপেক্ষা করতে হবে কেন! অবশ্য বিঞ্জানীরা বলছে দ্রুতই তলাবে। খুব একটা সময় নেবে না। আমার মনে হচ্ছে নৌকার মতো করে দুনিয়াটা এখনই তলিয়ে দিই। নিশ্চয় দুনিয়ার একটা ফুটো আছে। সেটা কোথায় আছে তাও মনে হয় আমি জেনে গেছি। ফুটোর গেটিসটা খুলেও দিয়েছি হয়তো। তাইতো বিজ্ঞানীরা বলছে দুনিয়া তলিয়ে যাচ্ছে। শালারা পারেও! পারবেইতো, ওরাতো আমারই জাতভাই। লম্বা লম্বা কথাইতো আমাদের বাঁচিয়ে রেখেছে। হাজার শিশুকে ভুখা রেখে যে মঙ্গলগ্রহে পাথর কুড়াতে যাচ্ছি, তাতো পারি বলেই নাকি? ঈশ্বরের নির্দেশে দুনিয়া তলিয়ে যাওয়ার কথাওতো আমরা জানি। পাপিষ্ঠ কতটা ধ্বংস হয়েছিল তাওতো দেখতেই পাচ্ছি। পাপিষ্ঠ হলো তেলাপোকার জাতভাই, দুনিয়া ধ্বংস হয়ে যাবে মানুষের কিছু হবে না, অন্তত যারা পাপী। পাপীরা মহান, জগতে যা-কিছু সৃষ্টি তার পুরো অবদানই পাপের। পাপ যে বৃক্ষের বীজ মতন। রাজা বলেছেন, গ্রেটওয়াল না বানানো হলে মঙ্গলদের লুটতরাজ থামানো যাবে না। প্রায় ৩ মিলিয়ন মানুষের জীবনের বিনিময়ে তৈরী হলো ১৫০ হাজার ফুট গ্রেটওয়াল ২০০ বছর ধরে। মানুষ একটি মহান অত্যাশ্চর্য কীর্তির জন্যে ধন্য-ধন্য করবে হাজার হাজার বছর। সবার অবশ্যই খুশি হওয়া উচিৎ। নয়কি? কেননা আমি সূর্যকে ধারণ করি আমার কব্জিতে। কেননা আমিই প্রথম প্রাণী যে ডাঙ্গায় এবং জলে দৌড়াতে পারি। আমি কী কী পারি তা প্রায় সবারই জানা। খুব দ্রুত শিখতে পারি, শেখাতে পারি। আমার সকল উন্নতির মূল যে মিথ্যা তা প্রাণীকুলে শুধু আমিই বলতে পারি। দাদী বলতেন, প্রাণীকুলে শেয়াল সবচেয়ে বুদ্ধিমান। শেয়ালের সাতচেলা বুদ্ধি। সে মিথ্যাও বলতে পারে। শিয়ালের এই জ্ঞান-গরিমার খবর প্রাণীকুলে কারোই জানতে বাকী নাই। একবার এক বোকা কুমির তার সাত ছেলেকে লেখাপড়া শেখাবে বলে শিয়াল মশায়ের কাছে নিয়ে আসে। শিয়াল তো দেখে আহ্লাদে আটখানা, সাত সাতটি কুমিরের নাদুসনুদুস বাচ্চা! কুড়মুড়ে হাড়, তুলতুলে গোস্ত! জিহ্বায় যেন সমুদ্রের ঢেউ। কিন্তু উতলা হলে চলবে না। ধৈর্য ধরতে হবে। মিথ্যুকের সবচেয়ে বড় গুণ ধৈর্য, আর এই ধৈর্য আসে জ্ঞান থেকে। বোকারা কখনও ধৈর্য ধারণ করতে পারেনা। শিয়াল হাসিমুখে কুমিরকে বিদায় দেয়। পরেরদিন কুমির সূর্য ওঠার আগেই এসে হাজির ছেলেদের খোঁজখবর নেয়ার জন্যে। এইতো শিয়ালের মিথ্যা বলা শুরু। গতরাতে ডিনার হয়েছে একছেলে, বাকী ছয়জনকে সাতজন বলে চালিয়ে দাও। দুরুদুরু বুকে শিয়াল এক-এক করে ছয় ছেলেকে সাতবার দেখিয়ে বিদায় করে বোকা কুমিরকে। কুমিরতো মহাখুশি, শিক্ষাদীক্ষায় বেড়ে উঠছে সাত ছেলে। দিন যায়, কুমিরও রোজকারমত খোঁজ নেয় বাচ্চাদের। সবকিছু চলছে ঠিকঠিক।
আমি দাদীকে বলি, দাদী এই মিথ্যা কি তুমি বলছো না শিয়াল? দাদী বলে ঘুম পাড়িয়ে দেওয়ার এটা মহৌষধ দাদু। তুমি ঘুমাও। জগতে কিছুই মিথ্যা নাই।
চাঁদের গন্তব্যে হাঁটি
আকাশ অন্ধকার হয়ে আছে যুগ যুগ ধরে। পাখি ও চাষীরা বৃষ্টিপতনের আপেক্ষায়। ওরা বরাবরই প্রকৃতিজীবি পতঙ্গ। নদীর মুখও আকাশের দিকে। বালুদের হাহাকার কেবল পাখিরাই শুনতে পায়। অনেকদিন হলো পাখিদের স্বর নামতে নামতে ফিসফিসানিতে রূপ নিয়েছে। হঠাৎ কয়েক ফোঁটা বৃষ্টি সমস্ত চরাচরে স্বপ্নের কোলাহল তৈরী করে। আমরা সবাই ঘরের বাইরে আসি হাজার বছর পর। আকাশ নাই, কেবল এক নক্ষত্রহীন অন্ধকারে কয়েকটি সোনালী ডানার চিল মেঘের প্রত্যাশায় একটু এগিয়ে গেলে কী এক অজানা আচম্বিতে তাদের চোখ ফেটে রক্ত ঝরে পড়ে। আমরা খুশিতে চনমনে মন নিয়ে দৌড়ে গিয়ে রক্তবৃষ্টির ফ্যাসাদে পড়ে হাবুডুবু খাই। আমাদের মাঝে কেউ কিছু বলে না, যারা বলে তাদের কথা আমরা কিছুই বুঝি না। কেবল হাবুডুবু খাই। এবং একটি অজানা আশঙ্কায় চুপচাপ বসে থাকি। কারো চোখে চোখ রাখার দায়মুক্তির বাসনায় দৃষ্টি রাখি নিজের চোখে। তবুও চোখ যায়, আকাশের নীল খুঁজে খুঁজে হয়রান হয়, চিলের রক্তচক্ষু আমাদের অন্তরে গেঁথে থাকে কয়েকশ বছর। আমরা ভুলে যেতে চাই, ভুলেও যাই, যাওয়ার প্রাক্কালে আরেকবার হানা দেয়; আরো একটি রক্তবৃষ্টি, আমাদের জমিনে বুনন করে প্রিয় শোকগাথা।
আমরা শোকগাথার প্রেমে পড়ি। গোল হয়ে বসে নন্দিনীর বাসায় আমরা শোকগাথা শুনি। আমরা বৃষ্টিমুখর সন্ধ্যার কথা শুনি। আমরা কলকলে জল আর নদীর সাথে পাখির ভালবাসাবাসির কথা শুনি। রূপালী রোদের কথা শুনি, সোনালী ধানের কথা শুনি। লজ্জাবতী বউটির কথা শুনি, দুধেল গাইটার কথা শুনি। নানীবাড়ির বিড়ালটা যে দুধের সরের উপর ঘুমাতো তার কথা শুনি। আমরা কৃষ্ণের বাঁশীর কথা শুনি, রাধার আকুলতার কথা শুনি। দোয়েলের কান্নায় ঘুম থেকে জেগে ওঠার কথা শুনি। শালুকের পাতায় চাঁদ মুড়িয়ে রাখার কথা শুনি। জোনাকীর আলোয় শিয়ালের বিয়ের কথা শুনি। হুতুমপেঁচার কণ্ঠে সরষে ফুলের গন্ধ ঝরেপড়ার কথা শুনি। বোয়াল মাছের পেট থেকে নোলক ছিনিয়ে আনার কথা শুনি। তেলের শিশি ভেঙ্গে ভাগ করার কথা শুনি। রাখাল কর্তৃক রাজ্য উদ্ধারের কথা শুনি। কেবল শুনি। এবং তার কিছুই আর দেখি না। দেখার বাসনায় আমাদের মধ্যে শোকানুভূতির জন্ম হয়। আমরা শোকগাথা রচনায় মনোনিবেশ করি। আমরা আমাদের শোকগাথাকে চমৎকার রুমালে পুটলি করে সোনার সিন্দুকে তুলে রাখি।
অতঃপর আমরা সময়-সময় তা খুলে-খুলে দেখি ও দেখায়। আমাদের দৈনন্দিন জীবনযাপনে একটি বাড়তি জাগৃতি হিসাবে সে চেতনে-অবচেতনে ক্রিয়াশীল থাকে। আমাদের যা-কিছু অর্জন তার সাথে পাল্লা দিয়ে চলে, যেমন চলি আমরা জ্যোৎস্নারাতের চাঁদের সাথে। নদীর পাড় ধরে হাঁটি, হাঁটতে হাঁটতে বুড়া হয়ে যায়। তাও চাঁদ যে পেছন ছাড়ে না! আমরা চাঁদকে পেছনে রেখে চাঁদের গন্তব্যে হাঁটি।
দিন যায়, মাস যায়, বছর পেরিয়ে রাত্রি নামে। আমরা রাত্রির সাথে কথা বলার অপেক্ষায় থাকি। নিজের ব্যাপারে ও নিশ্চয় ভালো বলতে পারবে। চাঁদের আলো কবে সূর্যের চেয়ে জ্যোতির্ময় হবে তা আর ওর চাইতে বেশী জানে কে? আমাদের মাঝে যারা কৈ-মাছের-প্রাণ নিয়ে জন্মেছে তারা রাত্রির মুখ খুঁজে ফেরে। আমরা তাদের সাথে চলি অথবা চলি না। আমরা দূরে দূরে থাকি কিন্তু বিযুক্ত হই না। রাত্রির আচম্বিত ঢেউয়ে ভেসে আসে সোনালী মাছ; তারা ডাঙ্গায় এসে বসবাস করা শুরু করে। আমরা তাদের সাথে কিছুতেই পেরে উঠি না। অতঃপর আমরা চুনোপুঁটির দলে ভিড়ে যাই। এখন আর আমাদের সাথে তাদের কোনো যুদ্ধ হয় না। শান্তিপূর্ণ সহ-অবস্তান। সোনালী মাছেরা আমাদের দেখভাল করে। মাঝে মাঝে ভুল করে দু-একটা খেয়েও ফেলে। তাতে আমরা আনন্দিত হই। নিজের সৌভাগ্যের শুকরিয়া আদায় করতে উঠেপড়ে লাগি। আমরা সারাদিন কী কী দুর্ভাগ্য কার জুটলো তার খবর নিয়ে চারদিক তত্ত্বতালাশ করি। আমরা দেখি বিশাল একটা ডুবোজাহাজ পানির নীচে ডুবে গিয়ে ১১৮ জন মানুষ মেরে ফেলে। বিয়ের মুরগীর সাথে রোস্ট হয়ে যায় ১৫০ জন। প্রথম রাতে বাগদাদের বুকে বোমা পড়ে ১৫০০, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় বোমার কোনো বিকল্প নাই বলেই বিশ্বনেতাদের ধারণা। আকাশে উড়তে গিয়ে পানিতে ডুবে মরার সংখ্যাও কম না। আমরা সমুদয় খবরে বড়ই তৃপ্তি নিয়ে যার-তার উপর উপগত হই। প্রেয়সীর যুগল চাঁদের অলিতে-গলিতে হাঁটাহাঁটি করি।